আঙ্গুরের ইতিহাস, চাষ পদ্ধতি এবং আঙ্গুর গাছের পরিচর্যা
আঙ্গুর প্রায় সবারই পছন্দের একটি ফল। অন্যান্য ফলের চেয়ে আঙ্গুরের দামও বেশি। সুস্বাদু এই আঙ্গুর ফল দিয়ে ওয়াইন, রস, এবং জেলি-জ্যাম ইত্যাদি তৈরি করা ছাড়াও বাইরের বিভিন্ন দেশের নানারকম মুখরোচক রান্নায় এর ব্যবহার হয়। এছাড়াও আঙ্গুর শুকিয়ে কিশমিশ তৈরি হয়।
আঙ্গুরের ইতিহাসঃ আজ থেকে প্রায় ৬,০০০-৪,০০০ বছর আগে পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলের দিকে আঙ্গুরের চাষ শুরু হয়। ৪,০০০ বছর আগে জর্জিয়ায় ওয়াইন তৈরির প্রমাণ খুব ভালোভাবে পাওয়া গেছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় যে, ১৩০০ শতাব্দীতে পার্শিয়ানরা ভারতীয় উপ-মহাদেশে প্রথম আঙ্গুর চাষ প্রবর্তন শুরু করেন,যা পরবর্তীতে ভারতের দক্ষিনাঞ্চলে বিস্তার আকার লাভ করে। ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের উঞ্চ আবহাওয়ায় সফলভাবে আঙ্গুরের চাষ হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশেও আঙ্গুরের চাষ হচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সবুজ ,লাল, সাদা, কালচে খয়েরি এমন নানা রঙের আঙ্গুর জন্মায়। এমনকি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার ফলে আজকাল বীচি ছাড়া আঙ্গুর জন্মানো সম্ভব হচ্ছে। সারা পৃথিবীর প্রায় ৭৫.৮৬৬ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আঙ্গুর চাষ হয়ে থাকে। তবে মোট উৎপাদনের ৭১% ওয়াইন বানাতে, ২৭% তাজা ফল হিসেবে এবং শুধু ২% শুকনো ফল হিসেবে ব্যবহার হয়। তাছাড়া কোথাও কোথাও এর পাতাও খাওয়া হয়ে থাকে।
আঙ্গুরের পুষ্টি উপাদানঃ আঙ্গুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বি ১, সি, কে ভিটামিন অন্যতম। এছাড়াও আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম ও খনিজ পদার্থ ম্যাঙ্গানিস। আঙ্গুর শুকিয়ে সাধারণত তৈরি হয় কিশমিশ এবং কিশমিশে রয়েছে ৬০ শতাংশ ফ্রুকটোজ।
জাতঃ আমাদের দেশে এ যাবত ৩ টি উৎপাদনশীল আঙ্গুর গাছের জাত নির্বাচন করা হয়েছে। (১) জাককাউ (২) ব্ল্যাক রুবী ও (৩) ব্ল্যাক পার্ল। তিনটি জাতই গ্রীষ্মকালীন এবং পরে তিনটি রঙের রূপান্তরিত হয়ে যথাক্রমে হালকা বাদামি, কালো ও করমচা রং ধারণ করে। ফলন আসতে সময় লাগে প্রায় দু’বছর।
জমি নির্বাচনঃ আঙ্গুর চাষের জন্য দো-আঁশযুক্ত লালমাটি, জৈবিক সার সমৃদ্ধ কাঁকর জাতীয় মাটি এবং পাহাড়ের পাললিক মাটিতে আঙ্গুর চাষ ভাল হয়। জমি অবশ্যই উঁচু হ’তে হবে যেখানে পানি দাঁড়িয়ে থাকবে না এবং প্রচুর সূর্যের আলো পড়বে এমন জায়গা আঙ্গুর চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরি ও রোপণ পদ্ধতিঃ ভালোভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করতে হবে। তারপর ৭০ X ৭০ X ৭০ সে. মি. মাপের গর্ত করে তাতে ৪০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে ১০/১৫ দিন রেখে দিতে হবে। যেন সারগুলো ভালোভাবে মাটির সাথে মিশে যায়। তারপর সংগৃহীত চারা গোড়ার মাটির বলসহ গর্তে রোপণ করে একটি কাঠি গেড়ে সোজা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে এবং হালকা পানি সেচ দিতে হবে। শাখা-কলমের বেলায় প্রায় ১ ফুট দীর্ঘ শাখা-খন্ডের ১/৩ অংশ মাটির নিচে কাত করে পুঁতলে ভালো হয়। আঙ্গুর চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় মার্চ-এপ্রিল মাস।
সার প্রয়োগ: রোপণের ১ মাসের মধ্যে বাড়বাড়তি না হ’লে গোড়ার মাটি আলগা করে তাতে ৫ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা দরকার। ১-৩ বছরের প্রতিটি গাছে বছরে ১০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। পটাশ সার ব্যবহারে আঙ্গুর মিষ্টি হয় এবং রোগ বালাইয়ের উপদ্রব কম হয়। বয়স্ক গাছের জন্য প্রতি বছর এপ্রিল মাসে দুই কেজি তেলের খৈল, এক কেজি হাড় চূর্ণ এবং এক পোয়া সালফেট অব পটাশ ব্যবহার করা যায়।
আঙ্গুর গাছের পরিচর্যা:
গাছের কান্ড ছাঁটাই: রোপণের পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মাচায় ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুর গাছের কান্ড ছেঁটে দিতে হবে। কান্ড ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে আঙ্গুর গাছের ফলন বৃদ্ধি হয় এবং ফুল ঝরে পড়া কমে যায়। ছাঁটাইয়ের ৭ দিন আগে এবং পরে গোড়ায় হালকা সেচ দিতে হয়। গাছ রোপণের পর মাচায় ওঠা পর্যন্ত প্রধান কাণ্ড ছাড়া অন্য সকল পার্শ্বের শাখা ভেঙ্গে ফেলতে হবে।
প্রথম ছাঁটাইঃ মাচায় কান্ড ওঠার ৩৫/৪৫ সে.মি. পর প্রধান কান্ডের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে, যাতে ঐ কান্ডের দুই দিক থেকে দু’টি করে চারটি শাখা গজায়।
দ্বিতীয় ছাঁটাইঃ গজানো চারটি শাখা বড় হয়ে ১৫-২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সে.মি. লম্বা হবে, তখন ৪ টি শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে, যেখান থেকে আরও পূর্বের ন্যায় দু’টি করে ১৬টি প্রশাখা গজাবে।
তৃতীয় ছাঁটাইঃ এই ১৬টি প্রশাখা ১৫/২০ দিনের মাথায় ৪৫/৬০ সে.মি. লম্বা হবে, তখন আবার এদের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে যাতে প্রতিটি প্রশাখার দু’দিকে দু’টি করে ৪ টি নতুন শাখা এবং এমনিভাবে ১৬ টি শাখা থেকে সর্বমোট ৬৪টি শাখা গজাবে। অবশ্য সর্বক্ষেত্রেই যে ৬৪ টি শাখা গজাবে এমন কোন কথা নেই। এই শাখার গিরার মধ্যেই প্রথমে ফুল এবং পরে এই ফুল মটর দানার মত আকার ধারণ করে আঙ্গুর ফলে রূপান্তরিত হবে। প্রথম বছর ফল পাবার পর শাখাগুলোকে ১৫/২০ সে.মি. লম্বা রেখে ফেব্রুয়ারী মাসে ছেঁটে দিতে হবে। ফলে বসন্তের প্রাক্কালে নতুন নতুন শাখা গজাবে এবং ফুল ধরবে। এই পদ্ধতি ৩/৪ বছর পর্যন্ত চলবে এবং ফলের স্থিতি লাভ করবে।
আঙ্গুর গাছের বিভিন্ন পরিচর্যার মধ্যে একটি হলো ডাল ছাঁটাই। প্রতিবার ফুল ধরার পর ডাল বা শাখাটি পুরনো হয়ে যায় এবং ঐ ডাল বা শাখায় আর ফুল-ফল ধরে না। এসব পুরনো ডাল বা শাখা গাছে থাকলে নতুন শাখা-প্রশাখা গজায় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রতি একরে ৪৩৬টি আঙ্গুর গাছে লাগানো যায়।
আঙ্গুর ফল পুষ্ট হওয়ার পর পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়তে হয়। আগে পেড়ে ফেললে পরে আর পাকে না। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আঙ্গুর গাছ ছাঁটাই করলে মার্চ-এপ্রিলে ফল পাওয়া যায়। তবে দেরিতে ফল সংগ্রহ করলে আকাশ একটানা মেঘলা থাকা বা বৃষ্টির কারণে ফল টক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ গরমে আঙ্গুর ফলে চিনিজাতীয় পদার্থ বেড়ে যায়। ফল ঠিকমতো বড় ও মিষ্টি না হলে, ফল ধরার পর প্রতি লিটার পানিতে ৫০ মিলিলিটার ইথরেল ও ১০০ মিলিগ্রাম জিবারেলিক অ্যাসিড পাউডার (জিবগ্রো ৫জি বা বারান্টো-৮০%) একত্রে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করলে উপকার পাওয়া যেতে পারে।
বছরে দুবার ফুল আসে। মার্চ ও জুলাই মাসে তা আঙ্গুরে রূপান্তরিত হয়। আঙ্গুর পাকার সময় বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকায় মাচার উপরে পলিথিন সীট দিয়ে আবৃত করে দিতে হবে যাতে গাছে বৃষ্টির পানি না লাগে। লাগলে পাকা আঙ্গুর ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিনটি পরিচর্যা নিয়মিতভাবে করতে হবে:
(ক) প্রতি বছর জানুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে গাছের গোড়ায় মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে আলগা করে তাতে অনুমোদিত সার প্রয়োগ করে শুধুমাত্র একবার বেশি করে পানি দিতে হবে।
(খ) জানুয়ারী মাসের ৪র্থ সপ্তাহে ঘুমন্ত গাছের শাখা-প্রশাখা ছাঁটাই করে দিতে হবে। ছাঁটাইকৃত ডালগুলো কেটে পরে মাটিতে পুতে পানি দিলে পুনরায় নতুন গাছ হবে।
(গ) ফেব্রুয়ারী মাসের ১ম সপ্তাহে সামান্য গরম আরম্ভ হবার সাথে সাথে গাছের গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে, যে পর্যন্ত না বৃষ্টি হয়। পানি দেবার ১০ দিনের মধ্যে গাছে নতুন শাখা-প্রশাখা গজাবে এবং তাতে ফুল দেখা দিবে। যা পরবর্তীতে আঙ্গুরে রূপান্তরিত হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!
আঙ্গুর ফল কি খুব বেশি টক হবে?
সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে আঙ্গুর খুব বেশি টক হবে না।
Pingback:Agriculturelearning-The biggest field of agricultural information in Bangladesh