পানের পোকা-মাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনা।পানের রোগ বালাই ও প্রতিকার
পান একটি অর্থকারী ফসল। আমাদের দেশে পানের বরজ খুব বেশি দেখা না গেলেও এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। দেশে বিদেশে পানের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এতে অনেক ঔষধি গুণ বিদ্যমান। কিন্তু রোগবালাই পান উৎপাদনের প্রধান অন্তরায়। পানে গোড়া পচা, ঢলে পড়া, পাতা পচা, অ্যানথ্রাকনোজ, সাদা গুঁড়া ইত্যাদি রোগ দেখা যায়। এছাড়া পানের কালো মাছি রোগ, পানের বরজের উইপোকা ইত্যাদি পোকা মাকড় দেখা যায়। পোকা মাকড় ও রোগ বালাইগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে পানের ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
পানের পোকা মাকড় ও দমন ব্যবস্থাপনাঃ
১।পানের কালো মাছি (Black Fly of Betel Leaf)
লক্ষণঃ
- পূর্ণ বয়স্ক পোকা ও কীড়া উভয় অবস্থায় ক্ষতি করে।
- এরা পান পাতার রস চুষে খায়।
- আক্রান্ত পাতা হালকা বাদামি রঙের হয়।
প্রতিকারঃ
- আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করতে হবে।
- পানের বরজ ও আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
- আক্রমন বেশি হলে টলস্টার ২ মিলি, ডায়মেথয়েট ( টাফগর/ রগর ) ১ মিলি/ লিটার পানিতে স্প্রে করতে হবে।
২। পানের বরজের উঁইপোকা (Termite of Betel Leaf )
লক্ষণঃ
- উঁইপোকা পানের লতার কোন ক্ষতি করে না।
- এটি পানের বরজ তৈরির উপকরণ নষ্ট করে।
- ফলে পানের বরজ খাড়া থাকতে পারে না।
- এতে ফলন বিশেষভাবে কমে যায়।
প্রতিকারঃ
- মুড়ি পান চাষ করা যাবে না।
- সেচ দিয়ে ক্ষেত ডুবিয়ে রাখতে হবে।
- উঁইপোকার ঢিবি সংগ্রহ করে রাণী মেরে ফেলতে হবে।
- আক্রমন বেশি হলে নাইট্রো ৪ লিটার/হেক্টর, ডার্সবান বা পাইরিফস ( ক্লোরপাইরিফস) ৫ মিলি/লিটার পানিতে স্প্রে করতে হবে।
পানের রোগ বালাই ও প্রতিকারঃ
১. রোগের নাম : কাণ্ড পচা/গোড়া পচা (Stem rot/Collar rot/Foot rot)
রোগের কারণ : স্ক্লেরোসিয়াম রফসি (Sclerotium rolfsii) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে। মাটিতে বেশি জৈব সার ও খড়কুটা থাকলে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
- গ্রীষ্মকালে মাটির ওপর শায়িত লতায় এ রোগ দেখা যায়।
- গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। তাই গোড়ায় লক্ষ করলে দেখা যাবে মাটির কাছের একটি বা দুটি পর্ব মধ্য কালো বর্ণ ধারণ করেছে।
- উপরের লতার পাতা হলুদ হয়ে যায় ও ঝড়ে পড়ে।
- মাটি সংলগ্ন লতার ওপর সাদা সুতার মতো মাইসেলিয়া (ছত্রাক ) দেখা যায়। পরে হালকা বাদামি থেকে বাদামি সরিষার ন্যায় এক প্রকার অসংখ্য দানার মতো স্কেরোসিয়া দেখা যায়।
- মাটি সংলগ্ন ডাঁটা পচে যায় এবং গাছ ঢলে পড়ে মরে যায়।
রোগের প্রতিকার :
- রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে।
- গভীর ভাবে জমি চাষ দিয়ে রোদ্রে ভালো করে শুকিয়ে নিতে হবে।
- পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নতুন বরজ তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ সবল রোগমুক্ত পানের লতা সংগ্রহ করতে হবে।
- ট্রাইকোডারমা কম্পোস্ট সার প্রতি গাছে ৫ গ্রাম হারে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
- লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা অটোস্টিন বা নোইন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে।
- বরজে রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি স্কোর বা ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ বা ২ গ্রাম কম্প্যানিয়ন ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
- বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা অটোস্টিন বা নোইন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
- গাছের গোড়ায় কপার অক্সিক্লোরাইড বা ১% বর্দোমিকচার ব্যবহার করতে হবে।
২. রোগের নাম : শিকড় পচা (Root rot)
রোগের কারণ : রাইজোকটোনিয়া সোলানি (Rhizoctonia solani) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : মাটি, ফসলের পরিতক্ত অংশ ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
- গাছের শিকড়সহ মাটির নিচের সব অংশই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
- প্রাথমিক অবস্থায় পাতা মলিন হয়ে ঢলে পড়ে। পরে লতা ঈষৎ বিবর্ণ হয়ে মরে যায়। এ অবস্থায় শিকড় লাল বর্ণ দেখায় এবং ভেঙে ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার :
- রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ থেকে তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগ প্রতিরোধী পানের জাত ব্যবহার করতে হবে।
- পানের বরজ সবসময় আগাছা মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
- সম্ভব হলে মাটি শোধন করতে হবে।
- লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা অটোস্টিন বা নোইন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে।
- বরজে রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা অটোস্টিন বা নোইন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৩. রোগের নাম : ঢলে পড়া (Wilt)
রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম অক্সিস্পোরাম (Fusarium oxysporum) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : ছত্রাকগুলো প্রধানত মাটি বাহিত এবং অন্যান্য শস্য আক্রমণ করে এবং পানি সেচের মাধ্যমে আক্রান্ত ফসলের জমি হতে সুস্থ ফসলের মাঠে বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
- গাছের গোড়ায় আক্রমণ করে। গাছের উপরের পাতা হলুদ হয়ে যায়।
- কাণ্ডের ভাস্কুলার টিস্যুতে আক্রমণ করে। গোড়ার দিকে কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে ফাটালে ভেতরে দাগ দেখা যায়। পরে গাছ ঢলে পড়ে। আক্রমণ বেশি হলে গাছ মরে যায়।
রোগের প্রতিকারঃ
- রোগাক্রান্ত গাছ তুলে এবং ফসল সংগ্রহের পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- গাছের গোড়ার চতুর্দিকের পৃষ্ঠের মাটি নেড়ে শুষ্ক করে দিলে এ রোগ অনেকাংশে দমন হয়।
- লতা রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে প্রোভেক্স বা অটোস্টিন বা নোইন দ্বারা লতা শোধন করে নিতে হবে।
- রোগ দেখা দিলে প্রোভেক্স বা অটোস্টিন বা নোইন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় মাটিতে স্প্রে করতে হবে।
৪. রোগের নাম : গোড়া–লতা ও পাতা পচা (Foot rot/vine rot and leaf rot)
রোগের কারণ : ফাইটোফথোরা প্যারাসাইটিকা (Phytophthora parasitica) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : কম ম্যাগনেসিয়াম ও বেশি লবণাক্ত মাটিতে রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। অবিরত বৃষ্টিপাত হলে এবং আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ বিস্তার লাভ করে।
রোগের লক্ষণ :
- প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় পানি ভেজা হলুদাভ বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। ধীরে ধীরে দাগ প্রসারিত হয়ে বড় হতে থাকে। দাগ পাতার কিনারা হতেও শুরু হতে পারে। অবিরাম বৃষ্টিপাত স্থলে রোগটি পাতা হতে বোঁটায় এবং লতায় সংক্রমিত হয়ে থাকে।
- আক্রান্ত পাতা ও লতায় এক প্রকার কালো দাগ পড়ে। পরে ওই দাগের মাঝখানে বিবর্ণ হয়ে পচে যায়।
- আক্রান্ত পাতা ঝরে পড়ে। পরবর্তীতে গাছের শিকড়, লতা ও পাতা পচে এক প্রকার দুর্গন্ধ নির্গত হয়। এভাবে আক্রমণ বেশি হলে গাছ মারা যায়।
রোগের প্রতিকারঃ
- রোগাক্রান্ত গাছের পাতা তুলে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগমুক্ত লতা বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
- রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-২ চাষ করতে হবে। ঘন ঘন সেচ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
- ট্রাইকোডার্মা জীবাণু সার ৫ গ্রাম হারে প্রতি গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।
- বরজে রোগ দেখা দিলে কনটাফ ৫ ইসি ১ মিলি/ লিটার পানিতে অথবা রিডোমিল গোল্ড বা কম্প্যানিয়ন প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে গাছের গোড়াসহ সব গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৫. রোগের নাম : ক্ষত বা পাতার দাগ (Anthracnose)
রোগের কারণ : কোলেটোট্রিকাম পাইপারিস (Colletotrichum piperis) নামক ছত্রাক।
রোগের বিস্তার : বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকলে দ্রুত রোগ বাড়ে।
রোগের লক্ষণ :
- প্রথমে পাতায় বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট ফোস্কার মতো অসম দাগ পড়ে। দাগগুলো কিনারা থেকে ভেতরের দিকেই বেশি দেখা যায়।
- দাগগুলো হালকা বাদামি থেকে গাঢ় বাদামি হয় এবং চারিদিকে হলুদ বর্ণের হয়। দাগগুলো ক্রমশ বড় হতে থাকে। ফলে অনেক দাগ এক সঙ্গে মিলিত হয়ে বড় দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি করে।
- পরে প্রতিটি দাগের মাঝখানে কালো ও চারপাশে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। দাগগুলোর মাঝখানটা শুকিয়ে যায় এবং সমগ্র পাতা নষ্ট হয়ে পড়ে। বেশি দাগ হলে পাতা খসে পড়ে।
রোগের প্রতিকার :
- রোগাক্রান্ত লতা-পাতা বরজ হতে তুলে পুড়ে করতে হবে। নতুন বাগানের জন্য রোগমুক্ত লতা রোপণ করতে হবে ।
- রোগ প্রতিরোধী জাত বারি পান-১ ও বারি পান-২ চাষ করতে হবে। বরজে রোগ দেখা দিলে টিল্ট ২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে ১০ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৬. রোগের নাম : সাদা গুড়া (Powdery mildew)
রোগের কারণ : অয়িডিয়াম পাইপারিস (Oidium piperis)
রোগের বিস্তার : গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া এবং ৫০ থেকে ৬০% বাতাসের আর্দ্রতায় এ রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় ।
রোগের লক্ষণ :
- পাতার নিচের পিঠ সাদা থেকে হালকা বাদামি গোলাকৃতি পাউডার লাগানো দাগ পড়ে। পরে দুই পিঠেই দাগ হয়।
- দাগগুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং সব পাতায় ছড়িয়ে পড়ে। দাগ পড়া এলাকাটি পরে বাদামি রঙের হয়, শুকনো ও ভঙ্গুর হয়।
- কচি পাতা আক্রান্ত হলে সে পাতা আর বাড়ে না এবং বিকৃত হয়ে যায়। আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে গাছ থেকে ঝরে পড়ে। লতার বৃদ্ধি বাধা প্রাপ্ত হয়।
রোগের প্রতিকার :
- রোগমুক্ত গাছ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে।
- ফসল সংগ্রহের পর অবশিষ্টাংশ এবং আর্বজনা পুড়ে ফেলতে হবে।
- দ্রুতবেগে পানি স্প্রে করলেও রোগের প্রকোপ কমে যায়।
- রোগ দেখা দিলে থিউভিট ৮০ ডব্লিউজি অথবা কুমুলাস ডিএফ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
- রোগের আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে অটোস্টিন ১ গ্রাম অথবা টিল্ট ২৫০ ইসি ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!