মাশরুম (Mushroom) চাষ পদ্ধতি। উপযোগী জাতসমূহ ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা
মাশরুম (Mushroom) ছত্রাকজাতীয় পরজীবী উদ্ভিদ যা দেখতে ব্যাঙের ছাতার মতো। মাশরুম ও ব্যাঙের ছাতা দেখতে একই রকম হলেও এদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে জন্ম নেওয়া কোন কোন মাশরুম বিষাক্ত হয় বিধায় সেগুলো খাওয়া যায় না। সূর্যের আলোয় প্রাকৃতিকভাবে খুব বেশি মাশরুম জন্মাতে পারে না। সেজন্য বাংলাদেশের অনেক স্থানেই এখন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাশরুম চাষ করা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা মাশরুম অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং ওষুধিগুণসম্পন্ন একটি উৎকৃষ্ট সবজি। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু মাশরুম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সাভার, ঢাকা, নীলফামারী ( সৈয়দপুর ), পার্বত্য চট্টগ্রাম, মধুপুর প্রভৃতি স্থানে এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে মাশরুম চাষ ও বাজারজাতকরণ হচ্ছে। মাশরুম চাষ অত্যন্ত লাভজনক কেননা মাশরুম চাষ করতে আবাদি কোন জমির প্রয়োজন হয় না।
মাশরুমের পুষ্টিগুণঃ মাশরুম প্রচুর পুষ্টিগুণ সম্পন্ন সুস্বাদু ও প্রোটিন সমৃদ্ধ সবজি। প্রতি ১০০ গ্রামে শুকনো মাশরুম থাকে ২০-৩০ গ্রাম প্রোটিন পাওয়া যায় বলেই মাশরুমকে সবজি মাংসও বলা যেতে পারে। মাশরুমে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সি, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস ও স্বল্প মাত্রায় ক্যালসিয়াম ও লৌহ জাতীয় পদার্থ রয়েছে। লৌহ কম থাকলেও সহজলভ্য অবস্থায় থাকে বলে মাশরুম রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে থাকে। মাশরুম অল্প ক্যালরি (Low calorie) সম্পন্ন খাবার। মাশরুম কম চর্বিযুক্ত (২-৮ % ), কোলেস্টেরলমুক্ত এবং লিনোলেয়িক এসিড সমুদ্ধ হওয়ায় তা হৃদরোগীদের জন্য খুবই উপকারী। মাশরুমে স্টার্চ বা শ্বেতসার থাকে না থাকলেও এতে আঁশ রয়েছে ৮-১০%। তবে শর্করার পরিমাণ কম থাকায় বহুমূত্র রোগীদের জন্য মাশরুম একটি আদর্শ খাবার।
মাশরুমের ঔষধিগুণঃ বাত ব্যাথা, কোমর, হাটু ব্যাথাসহ যেকোন ব্যাথায় খুব দ্রুত কাজ করে থাকে। মাশরুম জন্ডিস ও রক্ত বন্ধ হওয়ার কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মাশরুম উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে থাকে। নিয়মিত মাশরুম থেকে শারিরীক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি হয়। রক্ত সঞ্চালণ বৃদ্ধি পায় এবং সর্দি, কাশি দূর হয়। মাশরুম ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে, মেদ কমায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। মাশরুম প্রোটিনের হজম ক্ষমতা (Digestibility) ৭০-৮০ % হওয়ায় এটি হজমে সহায়তা করে।
মাশরুমের প্রজাতিঃ পৃথিবীতে প্রকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা প্রায় ৩ লাখ প্রজাতির মাশরুম রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার প্রজাতি খাওয়ার অযোগ্য। আনুমানিক ১০ হাজার প্রজাতির
ওপর গবেষণা চলছে। এদের মধ্যে মাত্র ৮-১০ প্রজাতির খাবার উপযোগী মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চাষযোগ্য মাশরুমের প্রজাতিগুলো হলো-
ক্রমিক নং | সাধারণ নাম | ইংরেজি নাম |
১ | ঝিনুক মাশরুম | Oyster mushroom |
২ | দুধ মাশরুম | Milky mushroom |
৩ | কান মাশরুম | Wood ear mushroom |
৪ | বোতাম মাশরুম | Button mushroom |
৫ | বোতাম মাশরুম | Button mushroom |
৬ | শিতাকে মাশরুম | Shitake mushroom |
৭ | খড় মাশরুম | Paddy straw mushroom |
খাবারের উপযোগী মাশরুমঃ বাংলাদেশে সাধারণত চার জাতের খাবার উপযোগী মাশরুম চাষ হয়ে থাকে। যথা-
১. স্ট্র মাশরুম : ধানের খড়, শিমুল তুলা, ছোলার বেসন ও চাউলের কুড়া ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহার করে সাধারণত স্ট্র মাশরুম চাষ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মূলত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই জাতের মাশরুম চাষ করা হয়।
২. ইয়ার মাশরুম: সাধারণত বর্ষাকালে প্রাকৃতিকভাবে আম গাছে ইয়ার মাশরুম পাওয়া যায়। ইয়ার মাশরুম দেখতে অনেকটা কালচে রঙের। এই মাশরুম সারাবছর চাষ করা গেলেও মূলত বর্ষাকালে এর ফলন ভালো হয়ে থাকে।
৩. অয়েস্টার মাশরুম: বাংলাদেশে এই জাতের মাশরুম সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে। সারাবছরই এই মাশরুম চাষ করা যায় তবে শীত ও বর্ষাকালে এর ভালো ফলন হয়ে থাকে। অয়েস্টার বা ঝিনুক মাশরুম খুব অল্প জায়গার সহজেই চাষ করা যায়।
৪.বাটন মাশরুমঃ বর্তমানে বাংলাদেশেও এই মাশরুমের চাষ শুরু হয়েছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে বাংলাদেশের সাধারণ মাশরুম উদ্যোক্তা ও মাশরুম চাষিরা প্রতি শীতে অর্থাৎ নভেম্বর থাকে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রচুর বাটন মাশরুম উৎপাদন করতে পারবে। সম্প্রতি সাভারে অবস্থিত বায়ো-টেক মাশরুম বাণিজ্যিকভাবে বাটন মাশরুম উৎপাদন করছে।
মাশরুম চাষের প্রয়োজনীয় উপকরণঃ মাশরুম চাষ করতে সাধারণত বীজ বা স্পন প্যাকেট, ধানের খড়, পাতলা পলিথিন ব্যাগ, ঝুলন শিকা বা বাঁশ, ছিদ্রযুক্ত কালো পলিথিন সিট, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা পরিমাপের জন্য হাইগ্রোমিটার, ঘরের উষ্ণতা ও আদ্রর্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য হ্যান্ড স্প্রেয়ার, জীবাণুনাশক, ব্লেড বা ছোট ছুরি, বালতি এবং অন্যান্য আনুষাঙ্গিক উপকরণ দরকার হয়ে থাকে।
মাশরুম উৎপাদন কৌশল
চাষের উপযোগী স্থানঃ মাশরুম মূলত খোলা জায়গায় চাষ করা যায় না। ফলে মাশরুম চাষে আবাদী জমির দরকের হয় না। মাশরুম চাষ করার জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে খড় বা বাঁশের চালা দিয়ে ঘর তৈরি করলেই চলে। এছাড়া মাটির দেওয়াল বা বাঁশের বেড়া দিয়েও ঘর তৈরি করা যেতে পারে। ঘরের ভেতর যেন আলো প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য বাঁশের বেড়ায় মাটির প্রলেপ দিয়ে লেপে দিতে হবে।
অয়েস্টার মাশরুম চাষ পদ্ধতিঃ অয়েস্টার মাশরুমের বীজ বা স্পন এবং অন্যান্য দরকারি উপকরণসমূহ জোগাড় করে মাশরুম চাষ শুরু করতে হবে। তবে মাশরুম চাষের কিছু ধাপ আছে যা অনুসরণ করতে হবে।
১ম পদ্ধতি
- প্রথমে মাশরুম চাষ কেন্দ্র হতে মাশরুমের বীজ বা স্পন প্যাকেট সংগ্রহ করতে হবে। পরে বীজ বা স্পনের দুই পাশে কিছুটা গোল করে কেটে চেঁছে নিতে হবে।
- তারপর মাশরুমের প্যাকেট ৩০ মিনিটের জন্য পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানি থেকে ৩০ মিনিট পরে মাশরুমের প্যাকেট তুলে নিতে হবে।
- মাশরুমের প্যাকেট ৫ থেকে ১০ মিনিট উপুড় করে রাখতে হবে যাতে প্যাকেট হতে অতিরিক্ত পানি ঝরে যায়। পানি ঝরে গেলে ঘরের পূর্ব নির্ধারিত স্থানে এটি রেখে দিতে হবে। প্রতিদিন এর উপর অন্তত ৩-৪ বার পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
- সাধারণত ৩-৪ দিন পর কাটা জায়গা থেকে অঙ্কুর গজাবে। অঙ্কুর গজানোর পর সেখানে মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
- খাওয়ার উপযোগী মাশরুম উৎপন্ন হতে ৫ বা ৬ দিন সময় লাগবে। পরবর্তীতে খাবার উপযোগী মাশরুম উৎপন্ন হলে গোড়া থেকে তা তুলে নিতে হবে।
- বীজের যে জায়গাটি কাটা হয়েছিল সেখানে ব্লেড দিয়ে একটু চেঁছে দিতে হবে। পরবর্তীতে ঐ বীজ থেকে পুনরায় মাশরুম গজাবে।
- একটি আধা কেজি ওজনের বীজ বা স্পন প্যাকেট থেকে ৩-৪ বার অর্থাৎ তা থেকে মোট ২০০-২৫০ গ্রাম মাশরুম পাওয়া যাবে।
২য় পদ্ধতি
- প্রথমে মাশরুম চাষ কেন্দ্র থেকে বীজ বা স্পন সংগ্রহ করতে হবে। এরপর এক কেজি ওজনের ১ টি বীজের পলিথিন খুলে ভিতরের কম্পোস্ট গুঁড়ো করে নিতে হবে।
- ২ কেজি পরিমাণ ধানের পরিষ্কার ও শুকনো খড় নিতে হবে। পরে খড়গুলোকে ১ ইঞ্চি করে মেপে নিয়ে কেটে টুকরা করতে হবে।
- তারপর পরিমাণমতো পানি ফুটিয়ে নিতে হবে। জীবাণুমুক্ত করার জন্য ফুটন্ত পানিতে খড়ের টুকরোগুলো এক ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- পরে খড়গুলো পানি থেকে তুলে নিয়ে চিপে পানি শূন্য করে ১ টি পাত্রের মধ্যে রাখতে হবে।
- ৫ টি পলিব্যাগ নিয়ে এর ভেতরে প্রথমে কিছু খড় বিছিয়ে নিতে হবে এবং খড়ের উপর মাশরুম বীজের গুঁড়ো দিতে হবে। এভাবে একটি পলিব্যাগে ৪ স্তরে খড় এবং মাশরুম বীজের গুঁড়ো বিছিয়ে দিতে হবে। সর্বশেষ স্তরে আবার খড় বিছিয়ে দিতে হবে।
- এভাবে খড় বিছানো শেষ হলে খুব শক্ত করে প্রতিটি পলিব্যাগ বাঁধতে হবে।
- প্রতিটি পলিব্যাগের চারপাশে ১০-১২ টি ছিদ্র করে দিতে হবে। এরপর পলিব্যাগগুলোকে বীজে পরিণত হওয়ার জন্য ১৫-১৮ দিন এভাবে রেখে দিতে হবে।
- পরবর্তীতে ১৫-১৮ দিন পরে পলিব্যাগগুলো খুলে বীজের দলাগুলো বের করে নিতে হবে।
- বীজের প্রতিটি দলা শিকায় করে ঝুলিয়ে রেখে প্রতিদিন ৪-৫ বার পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
- এভাবে রাখার ৩-৪ দিন পর বীজের চারদিক দিয়ে মাশরুমের অঙ্কুর গজাতে শুরু করবে। পরবর্তীতে ৪-৬ দিন পরে খাওয়ার উপযোগী মাশরুম গোড়া থেকে তুলে নিতে হবে।
- এভাবে মাশরুম চাষ করলে লাভ বেশি হবে। কারণ প্রতিটি পলিব্যাগ থেকে প্রায় আধা কেজি মাশরুম পাওয়া যাবে। অর্থাৎ ৫ টি পলিব্যাগ থেকে প্রায় আড়াই কেজি মাশরুম পাওয়া হবে।
সাবধানতাঃ
- বীজ বা স্পনে কোনভাবেই যেন সূর্যের আলো না পড়তে সেদিকে খেয়াল করতে হবে। মাশরুম চাষের ঘরটি সবসময় ঠান্ডা রাখতে হবে। তবে গরম খুব বেশি পড়লে ঘরের চারদিকে বস্তা ভিজিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হবে।
- মাশরুম চাষের ঘর ও ঘরের বাইরের চারপাশে সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। অপরিচ্ছন্ন জায়গায় মাশরুম ফ্লাই বা মাশরুমের মাছি নামের পোকা মাশরুমের ক্ষতি করে।
- কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা যাবে না।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনঃ অরগানিক বা জৈব উপায়ে মাশরুম চাষের ক্ষেত্রে মাশরুমে মাছির উপদ্রপ দেখা দিলে বিভিন্ন প্রকার লাইট ট্রাপ ব্যবহার করে তা দমন করা যেতে পারে। এছাড়া মাশরুমে সবুজ বাদামি বা নীল মোল্ড দেখা দিলে লবণ দ্বারা আক্রান্ত স্থান কাভার করে দিয়ে তা দূর করা যায়।
প্রশিক্ষণঃ বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর আওতায় ঢাকা জেলার সাভারে ‘মাশরুম উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ রয়েছে যেখানে মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতি কর্মদিবসে যেকোন ব্যক্তি সকাল ১০টার মধ্যে সেখানে গেলে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব সাড়া পড়েছে। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সহজে ও সুন্দরভাবে মাশরুম চাষ করছে। সেখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাশরুমের উৎপাদন শিখানোর পাশাপাশি মার্কেটিং করার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করা হয়ে থাকে। সহযোগিতার লক্ষ্যে কতৃপক্ষ বাংলাদেশ মাশরুম ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনও করে দিয়েছে। মূলত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মাশরুম চাষিরা সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে, সেসব বিষয়েও এখানে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়ে থাকে।
বাজার সম্ভাবনাঃ বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর বিভিন্ন হোটেল, সুপার সোপগুলোতে ও চাইনিজ হোটেল্গুলোতে মাশরুমের অনেক চাহিদা রয়েছে। যার ফলে মাশরুমের বাজার মূলত শহরে গড়ে উঠেছে। এছাড়া বিদেশেও এর চাহিদা রয়েছে। ফলে মাশরুম শুকিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এজন্য বাংলাদেশ মাশরুম ফাউন্ডেশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি দেশের বাইরে সবজি ও কাঁচামাল রপ্তানি করে থাকে তাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে মাশরুম বিদেশে মাশরুম রপ্তানি করা সম্ভব।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!