করোসল (corossol), ক্যান্সার প্রতিরোধক নতুন ফল এখন বাংলাদেশে
করোসল ( corossol )ফলের ফলের অনেকগুলো নাম রয়েছে। সেগুলো হলো- গ্র্যাভিওলা, (Graviola), সোরসপ, গুয়ানাভা ও ব্রাজিলিয়ান পাও পাও। এই ফলের জন্য গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল বেশ উপযোগী। চায়না, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, ব্রাজিল, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে এই ফল খুব ভালো জন্মে। এ ফল শীতপ্রধান অঞ্চলে বাঁচতে পারে না।
করোসলের Common Names: “soursop”, “prickly custard apple” এবং Scientific Name: Annona muricata । করোসল ফলের গাছটি ২৫-৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং স্বল্প শাখা-প্রশাখাযুক্ত হয়ে থাকে। এর ফলটি দেখতে ক্রিকেট খেলার স্টেডিয়ামের মতো ওভাল আকৃতির হয়ে থাকে। গায়ে বৃন্তযুক্ত, হলদেটে সবুজ রঙের ফলটির ভক্ষণযোগ্য অংশটি জ্যুসি। এই ফলটি আতা ফলের মতো খাওয়া ছাড়াও পানীয় এবং শরবত হিসেবে গ্রহণ করা যায়। গ্রাভিওলা আম্লিক ফল হিসেবেও পরিচিত।
করোসল ফলের ঔষধি গুনাগুণঃ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ফল ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এই ফল খেলে ক্যান্সাররোগীর কেমোথেরাপির প্রয়োজন হয় না। এ ফল ক্যান্সার সেলের মৃত্যু ঘটাতে কেমোথেরাপির চেয়ে এটি ১০ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী।
করোসল গাছে রয়েছে অ্যানোনাসিয়াস অ্যাস্টোজেনিন নামে এক ধরনের যৌগ। এই যৌগ ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধি রুখে দেয়, যা কেমোথেরাপি করে। ফলে ক্যান্সার কোষ আর বাড়তে পারে না। বিশেষ করে স্তন ক্যান্সার, ফুসফুস ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, প্রসটেট ক্যান্সারে এটি বেশি কার্যকর।
এছাড়া নিয়মিত এই ফল খেতে পারলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বেড়ে যায়। শরীরও চাঙ্গা থাকে এবং দুর্বল ভাব আসে না। রক্তকে শোধিত করতেও এই ফলের গুণ অনস্বীকার্য। শুধু ফলই নয়, এই গাছের ছাল ও পাতায় লিভার সমস্যা, আর্থরাইটিস ও প্রস্টেটের সমস্যায়ও নিরাময় হয়ে যায়।
মাটিঃ করোসল ফলের জন্যে ৫-৬.৫ pH মাত্রার মাটি সবচেয়ে উপযোগী। মাটিতে নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে। বেলে মাটি এই ফলের জন্যে উপযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বীজসংগ্রহ ও চারা উৎপাদনঃ করোসল ( corossol ) মাঝ বরাবর কেটে বীজ সংগ্রহ করতে হয়। একটি ফলে মোটামুটি ১২-২০ টি বীজ থাকে। এরপর ঘরের অভ্যন্তরে ছায়াযুক্ত স্থান নির্বাচন করে অঙ্কুরোদগম হওয়ার জন্যে সুযোগ দেওয়া হয়। কুসুম গরম পানিতে বীজকে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরদিন একটি ট্রেতে কোকোডাস্ট, ভার্মিকুলাইট মিশিয়ে পিট তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। ২-৪ সপ্তাহ পর বীজের ট্রেটিকে আলোর সংস্পর্শে নিয়ে আসতে হবে। প্রতিদিন ৪-৬ ঘন্টা সূর্যের আলোর সংস্পর্শে রাখা বাঞ্ছনীয়। করোসলের বীজ ১৫-৩০ দিনের মধ্যেই অঙ্কুরিত চারা টবে রোপণের উপযুক্ত হয়ে যায়।
অঙ্কুরিত বীজটিকে এবার টব বা প্লাস্টিকের পাত্রে স্থান্তরিত করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে পাত্রটি যেন গাছের চেয়ে বড় হয়। পাত্রের নিচে ছিদ্র থাকতে হবে। মোটামুটি ১ মাসে মধ্যেই চারাগাছ টবে লাগানোর উপযুক্ত হয়ে যায়। টব বা প্লাস্টিকে পাত্রটি পটিংমিক্স দ্বারা পরিপূর্ণ থাকতে হবে। ট্রে থেকে খুব সতর্কতার সাথে চারা তুলে নিতে হবে যেন শিকড় ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। শেকড় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া করোসলের জন্যে বেশ ঝুকিপূর্ণ। এভাবে ৬ মাস বাড়তে দিতে হবে চারাকে।
চারা লাগানোর সময়ঃ ফাল্গুন মাসের শুরুতে বা বসন্তে করোসলের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
চারা রোপনের নিয়মঃ অঙ্কুরিত বীজটি বাগানে লাগানোর পূর্বে এর পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমন একটি জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেটি দক্ষিণমুখী, সূর্যের আলোযুক্ত স্থান। স্থানটি বাতাস সুরক্ষিত হওয়া অবশ্য জরুরী। করোসল গাছের শাখা-প্রশাখা বেশ ছোট হয়, ঝাপটা বাতাসে এর কান্ড ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্যে গাছ রোপণের জন্যে এমন স্থান নির্বাচন করা জরুরী যেখানে পেছনে দেওয়াল বা কোনো ভিত্তি আছে। যাতে বাতাস বেরিয়ে যাবার পথ না থাকে।
বীজ লাগানোর পূর্বে মাটি ঝরঝুরে করে নিতে র্যাকার চালাতে হবে, ২ ইঞ্চি পুরু করে কম্পোস্ট সার দিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে। ১২ ইঞ্চি চারাটি রোপণের ক্ষেত্রে একটি গাছ থেকে অপর গাছেত দূরত্ব হতে হবে ১২ ইঞ্চি। নইলে গাছ উপযুক্ত পুষ্টির অভাবে বেড়ে উঠতে পারবে না। গর্ত বড় করে করতে হবে যেন মূল গভীর পর্যন্ত যেতে পারে। মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পর ৩ ইঞ্চি পুরু করে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে আর্দ্রতা ধরে রাখতে।
সেচঃ করোসল (corossol ) ফলের গাছটি নিজেই নিজের আর্দ্রতা ধরে রাখতে পারলেও গ্রীষ্মকালে একে আলাদা সেচ দিতে হয়। শীতকালে অতিরিক্ত সেচ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। করোসল গাছ খরা সহিষ্ণু। তবে মাটি আর্দ্র থাকার ফলে পোকামাকড়ের সংক্রমণ বেশি দেখা দেয়।
সার প্রয়োগঃ করোসল গাছে নাইট্রোজেনঃ ফসফরাসঃ পটাসিয়াম = ১:১:১ অনুপাতে ৩ কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হয়। প্রথম বছর একটি গাছের জন্যে হাফ পাউন্ড ( অর্থাৎ ২২৭ গ্রাম ) পরিমাণ সার সমান ৩ ভাগে বিভক্ত করে ৪ মাস পর পর প্রয়োগ করতে হয়।
দ্বিতীয় বছর ১ পাউন্ড ( অর্থাৎ ৪৫৪ গ্রাম ) সার একই ভাবে প্রয়োগ করতে হয়। তৃতীয় বছর থেকে প্রতিবছর ৩ পাউন্ড ( অর্থাৎ ১৩৬২ গ্রাম ) সার প্রয়োগ করতে হয়।
করোসল গাছের যত্নঃ
- দ্বিতীয় বছরে গাছের কেন্দ্রীয় অগ্রপ্রান্ত ৩ ভাগের ১ ভাগ অংশ কেটে ফেলতে হবে।
- এরপর কাটা অংশের নিচ হতে নতুন শাখা গজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এটি দ্বিতীয় লম্বালম্বি শাখা তৈরি করতে সহায়তা করবে। এতে সংখ্যায় ফল বেশি পাওয়া যাবে একটি গাছ থেকে।
- ৩-৫ বছরের মধ্যে গাছে ফুল ধরা শুরু করবে। করোসল অনেক ধীর প্রজাতির উদ্ভিদ। ধৈর্য্য ধরতে হবে এর আকাশচুম্বী মূল্য ও ঔষধিগুণের জন্যে হলেও। এটি ফুল ধরা শুরু করলে প্রতিবছর ফল দিবে নিশ্চিন্তে।
ফল সংগ্রহঃ তিন-পাঁচ বছরের মধ্যেই গাছে করোসল ধরে। একেকটি করোসল গাছে ২৫০ গ্রাম-২.৫ কেজি আকৃতির ফল পর্যন্ত ধরে। করোসল হলদে সবুজ হওয়ার সাথে সাথেই সংগ্রহ করে নেওয়া শ্রেয়। একে গাছে নরম হতে দেওয়া উচিত না। এতে ফল বাজারজাতের সময় ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। ফল সংগ্রহের ৫-৬ দিনের মধ্যেই খেয়ে ফেলা শ্রেয়। এরপর এটিতে পচন ধরা শুরু করে। অনেক দিন প্রিজার্ভের জন্যে জ্যুস, পালপ তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে।
সম্ভাবনাঃ দেশের প্রতিটি নাগরিককে ফলজ বৃক্ষের পাশাপাশি ঔষধি গাছ লাগানোর জন্য সরকারিভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ঠিক সেই সময়, নীলফামারীর ডিমলায় খড়িবাড়ী ইউনিয়নের বন্দর খড়িবাড়ী গ্রামে সেনাবাহিনী কর্নেল আলমাস রাইসুল গনি (অব.) এর বাগানে শতাধিক ঔষধি গাছের মধ্যে এবার ধরেছে করোসল ফল।কর্নেল আলমাস রাইসুল গনি (অব.) তার বাড়িতে প্রায় ২ একর জমিতে নিজ উদ্যোগে লাগিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা মানব দেহের উপকারী শতাধিক ঔষধি ফলজ গাছ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেলে-দোঁআশ মাটিতে বাণিজ্যিকভাবে করোসল চাষে ভালো ফল আসতে পারে। তাঁর এই বাগানটি উত্তরাঞ্চলের মডেল বাগান হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
কর্নেল আলমাস রাইসুল গনি (অব.) তার বাড়িতে প্রায় ২ একর জমিতে নিজ উদ্যোগে লাগিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করা মানব দেহের উপকারী শতাধিক ঔষধি ফলজ গাছ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বেলে-দোঁআশ মাটিতে বাণিজ্যিকভাবে করোসল চাষে ভালো ফল আসতে পারে। তাঁর এই বাগানটি উত্তরাঞ্চলের মডেল বাগান হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!