কৃত্রিম প্রজনন । ব্যাক কৃত্রিম প্রজননের ( গবাদিপশুর ) বিস্তারিত
কৃত্রিম প্রজননের যাত্রা ব্র্যাক প্রতিষ্ঠানটিতে ১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছিল। কিভাবে পল্লী দরিদ্রদের উন্নতমানের গরুর বাচ্চা জন্ম দেওয়া যায় সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের অংশীদারিত্বমূলক উদ্যোগ হিসেবে ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজননের যাত্রা শুরু করেছিল। গ্রামীণ দরিদ্রদের গবাদিপশু উপর একটি সমীক্ষা চালায় এবং সেই সমীক্ষায় তারা দেখতে পায় একটি গাভি প্রতিদিন গড়ে ১.২৫ লিটার দুধ উৎপাদন করতে পারে (ব্র্যাক গবেষণা বিভাগের সমীক্ষা) এবং এই পরিমাণ উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে কখনই ভালোমানের উপার্জন করা সম্ভব নয়।
ব্র্যাকের ধারণা ছিল যে উচ্চ ফলনশীল দুগ্ধ উৎপাদন করার জন্য গাভির কৃত্রিম প্রজনন গ্রামীণ দরিদ্রদের সহায়তা করবে। কিন্তু ইতিহাসের ঐ সময়ে, সরকারের একাই উচ্চমানের ষাঁড়ের বীর্য সরবরাহ করতেন। গ্রামীণ দরিদ্ররা খুব কমই এই বীর্য দ্বারা কৃত্রিম গর্ভধারণের ব্যবস্থা করতে সক্ষম ছিলেন। সুতরাং, কৃত্রিম প্রজনন পরিচালনার জন্য নির্বাচিত সংখ্যক মানুষকে প্রশিক্ষণের জন্য ব্র্যাক এবং সরকারী কর্মীদের যৌথ প্রয়াস প্রকল্পে একটি সূচনা করেছিল।
প্রাথমিকভাবে, ব্র্যাক ১৩০ জন স্বেচ্ছাসেবীর কৃত্রিম গর্ভধারণ প্রযুক্তিবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং আজ অবধি ব্র্যাক ২,১৪১ টি কৃত্রিম গর্ভধারণ প্রযুক্তিবিদকে সফলভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এখন খুব কম লোকই গ্রামাঞ্চলে তাদের কার্যক্রম শুরু করার অপেক্ষায় রয়েছে।
কৃত্রিম প্রজননের পটভূমিঃ তরল এবং হিমায়িত দুটি ধরণের বীর্য সরকারের কাছে সরবরাহ ছিল। সরকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্র্যাকের এআই কর্মীদের দুগ্ধচাষিদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তরল বীর্য এবং সঠিক গর্ভাধানের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছিল। কিন্তু গ্রামগুলিতে অসামঞ্জস্য বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকার কারণে তরল বীর্য কেবল দুই থেকে তিন দিন স্থায়ী থাকতো। যা একটি সামগ্রিক উপায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৯৭ সালে, হিমায়িত বীর্যের জন্য সরকারের সীমিত সংস্থাগুলি প্রোগ্রাম থেকে কৃষকদের বিপুল সংখ্যক ড্রপ আউট তৈরি করেছিল। বিষয়টি মোকাবিলার প্রয়াসে ব্র্যাক সরকারের অনুমতি নেওয়ার পরে নিজস্ব ষাঁড় হিমায়িত বীর্য উৎপাদন শুরু করে। বিদ্যুৎবিহীন তাপমাত্রা রক্ষার জন্য ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের তরল নাইট্রোজেন সরবরাহ করেছিল।
ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজননে রুপান্তরঃ ১৯৯৮ সালে, ব্র্যাক আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছ থেকে তাদের উদ্যোগকে বিভক্ত করে এবং এর উন্নয়নের প্রচেষ্টা আরও বেশি গতিশীল করার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ব্র্যাক গ্রামীণ পর্যায়ে ব্যাপক কাজ করে এবং ২০০৭ সাল নাগাদ কৃত্রিম গর্ভধারণের বিকাশ কর্মসূচি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ব্র্যাক অবশেষে একটি স্বাধীন কৃত্রিম গর্ভধারণ সামাজিক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।
ব্র্যাক কৃত্রিম বীর্য উৎপাদন কেন্দ্রঃ ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে ব্র্যাকের কৃত্রিম গর্ভধারণের একটি ষাঁড় খামার রয়েছে। প্রথমদিকে এই খামারে ৩৫ টি ষাঁড় নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা হয়। বর্তমানে এটিতে ৭৩ টি ষাঁড় রয়েছে এবং ১৯ টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল রয়েছে। ব্র্যাক বাংলাদেশের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বৃহৎ আকারের ষাঁড় এবং হিমায়িত বীর্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বিতরণ কেন্দ্রের পথিকৃৎ। এখনও অবধি কোনও সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা ছাগল হিমায়িত বীর্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণে জড়িত নয়। আজকাল, ষাঁড় খামার থেকে, সব ধরণের হিমায়িত বীর্য ডিপোগুলিতে বিতরণ করা হয়। ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসিমিনেশনের সারা বাংলাদেশ জুড়ে ৭০ টি সিসিএ (ডিপো) রয়েছে। এখানে, কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা গড়ে ১৪০ টাকা বীর্য ক্রয় করেন তারপরে তারা কৃষকদের কাছে বীর্য ২০০-২৫০ টাকা করে বীর্য বিক্রি করে। কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা কেবল কৃষকদের গরু রক্ষা করেন না,বরং তারা সাধারণ স্বাস্থ্য (জল সরবরাহ, সঠিক পুষ্টি খাওয়ানো, আবাসন ও পরিচালনা, রোগ প্রতিরোধ, এবং গবাদিপশুর নির্বাচনের জন্য) তাদের গরুদের যত্ন নিতে প্রশিক্ষণ দেয়।
যখন কোনও কৃষকের গাভি উত্তাপ হয় ,তখন কৃষকরা একটি কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসেন এবং প্রযুক্তিবিদ সঠিক গর্ভধারণের জন্য ১২-১৮ ঘন্টার মধ্যে গরুটির জরায়ুতে বীর্য প্রদান করেন। কৃষকরা অবশেষে পুরুষ এবং স্ত্রী উভয় বাছুর থেকে উপকৃত হন। পুরুষ বাছুরের উচ্চ মানের জাতগুলি গড় পুরুষ বাছুরের চেয়ে আরও দ্রুত এবং বৃহত্তর আকার ধারণ করে, এগুলি গো-মাংসের আরও ভালো উৎস হিসেবে পরিণত করে। গরু যদি একটি মহিলা বাছুর জন্ম দেয় তবে এই বাছুরটি শেষ পর্যন্ত একটি উচ্চ ফলনশীল গরুতে পরিণত হবে। এক বছরে একটি বাছুরকে ডায়েরি করে লাভজনক ব্যবসা করার জন্য এআই কর্মীরা কৃষকদের সাহায্য সহযোগিতা করেন।
বর্তমানে, ব্র্যাক কৃত্রিম গর্ভধারণ সারা বাংলাদেশ জুড়ে ৬১ টি জেলায় তাদের সক্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং ২০১৫ সালে মোট ১.৬৪ মিলিয়ন গবাদিপশুর কৃত্রিম প্রজনন করানো হয়েছে। এই সকল জেলাগুলি ব্র্যাক দুগ্ধ ও খাদ্য প্রকল্পেও অবদান রাখে। ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসিমিনেশন অবশ্যই ব্র্যাক ডেইরির সাফল্যে অবদান রাখে, যা বাংলাদেশের দুধের চাহিদা বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে।
ব্র্যাকের এআই কর্মীরা এআই ছাড়াও এফএমডি ভ্যাকসিনেশন, সিএমটি কিট দ্বারা ম্যাসাটাইটিস পরীক্ষা, পশুর বীজ সরবরাহ, গবাদি পশুর বিক্রয়, খনিজ মিশ্রণ (মিনামিক্স) এবং ভেটেরিনারি চিকিৎসকদের দ্বারা আয়োজিত স্বাস্থ্য শিবিরের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করছে। বর্তমানে এটি গ্রামীণ অঞ্চলে অব্যাহত আছে।
ব্র্যাক প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভূমিকাঃ ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ দরিদ্রদের উপর লক্ষ করেছিল। যাতে করে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক তাদের উপার্জন বৃদ্ধি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনও সম্প্রদায় দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে তবে দরিদ্ররা গরু লালন ও দুধ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। ধনী ব্যক্তিরা দুধ এবং মাংসজাতীয় পণ্য থেকেও উপকৃত হন। ব্র্যাক পশুপালন, ভেটেরিনারি সায়েন্স স্টাডি, সামাজিক বিজ্ঞান এবং ব্যবস্থাপনার ডিগ্রি সহ দক্ষ কর্মী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন অত্যন্ত সফল হয়েছে, যা দেশের অন্যান্য কৃত্রিম প্রজননপরিষেবাগুলির গুণমানকে ছাড়িয়ে গেছে। কৃত্রিম গর্ভাধান খাতে সাধারণ অনুশীলন হলো কৃষকরা তাদের গরুকে গর্ভাধান কেন্দ্রগুলিতে প্রজননের জন্য নিয়ে থাকেন কিন্তু সেখানে গর্ভধারণের হার গড়ে প্রায় ৪৬ শতাংশ থাকে। ব্র্যাকের কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের গরু প্রজননের জন্য সরাসরি কৃষকের বাড়িতে আসেন এবং বর্তমানে তাদের গর্ভধারণের হার গড়ে ৬৫ শতাংশেরও বেশি। ব্র্যাকের বাংলাদেশে সর্বোচ্চ মানের ষাঁড় বীর্য রয়েছে যার ফলে কৃষকদের ব্র্যাক কৃত্রিম গর্ভধারণের পরিষেবাগুলি ব্যবহার করতে আকর্ষণ করেছে।
ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনাঃ ব্র্যাক আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন, লাভজনক সামাজিক উদ্যোগ হিসেবে, সারা বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজনন পরিষেবা সম্প্রসারণ এবং দুগ্ধ বিকাশের জন্য উদ্ভাবন প্রবর্তনের লক্ষ্যে নিয়মিত কাজ করে চলেছে। প্রাপ্ত মুনাফা ব্র্যাক শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচির জন্যও তহবিল প্রদানে ভূমিকা রাখে।
বর্তমানে একটি দুগ্ধ প্রজনন খামার ও ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের সুবিধা সহ বিভিন্ন পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। তারা ষাঁড়ের রক্তের স্তর ৫০-১০০ শতাংশে বাড়ানোরও পরিকল্পনা করে সর্বোচ্চ মানের ষাঁড়টিকে তৈরি করে।
Source: Top Bangla Pages
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!