About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

জারবেরা ফুলের আধুনিক চাষ পদ্ধতি। বংশবিস্তার। রোগ ও পোকামাকড় দমন

Please don't forget to share this article

জারবেরা এ্যাসটারেসী পরিবারভুক্ত বানিজ্যিক ফুল । জার্মান পরিবেশবিদ ট্রগোট জার্বার এর নামানুসারে এ ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক বানিজ্যিক কাট ফ্লাওয়ার (Cut flower) হিসেবে উল্লেখযোগ্য ১০টি ফুলের মধ্যে অন্যতম। কেননা এটি কাট ফ্লাওয়ারের জন্য ও বেশি দিন ফুলদানীতে সতেজ রাখার জন্য উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের যশোর-বেনাপোল সড়কের পাশে সদর উপজেলার মালঞ্চিতে গোল্ডেন সিড ফার্ম ২০১১ সাল থেকে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে জারবেরার চাষ করছে। দেশে সর্বপ্রথম জারবেরা ফুলের চাষ শুরু হয় ফুলের রাজধানী বলে খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালিতে। সেখানকার চাষিরা ভারত থেকে টিস্যু কালচারের চারা এনে চাষ করতেন। আমদানিকৃত ওই চারার প্রতিটির দাম পড়ত ৯০ টাকা করে।

কিন্তু বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক গবেষক মতিউর রহমান ও  প্রফেসর ড. এম মনজুর হোসেন রাজশাহীর আকাফুজি ল্যাবে দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে টিস্যু কালচারের চারা উৎপাদনে মনোনিবেশ করেন এবং সফল হন। এই চারার প্রতিটির দাম পড়ছে ৩০ টাকা করে। তাঁরা জানান, জারবেরা ফুলের বীজ থেকে চারা হয় না। মূল গাছের সাকার থেকে যে চারা হয় তা মানসম্পন্নও নয়  এবং ফুলের উৎপাদন কম। । এ কারণে বংশবৃদ্ধির জন্য টিস্যু কালচার প্রয়োজন। এই পদ্ধতিতে একসাথে অল্প সময়ে জীবাণুমুক্ত অধিক চারা পাওয়া যায়।

জাত

জারবেরা গণের আওতায় ৪০টির মতো প্রজাতি আছে। এ গুলির মধ্যে Gerbera jamesonii (জারবেরা জ্যামেসোনি) প্রজাতিটি বাংলাদেশে চাষা করা হচ্ছে। বর্তমানে সংকরায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে Gerbera jamesonii এর অনেক জাত উদ্ভাবিত হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট  জারবেরা  ফুলের বারি জারবেরা-১ ও বারি জারবেরা-২ দুইটি জাত উদ্ভাবন করেছে।

মাটি

জারবেরা চাষের জন্য সুনিষ্কাশিত, ঊর্বর দোআঁশ বা বেলে-দোআঁশ মাটি উত্তম। মাটির পিএইচ মাত্রা ৫.৫ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকা উচিত।

বংশবৃদ্ধি

(ক) বীজের মাধ্যমে (By seed)

বীজের মাধ্যমে জারবেরার বংশবৃদ্ধি করা যায়। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত গাছে মাতৃগাছের সকল গুনাবলী বজায় থাকে না, তবে পদ্ধতিটি সহজ। এ পদ্ধতির সুবিধা হলো  বীজের মাধ্যমে রোগ-পোকা আক্রমনের সম্ভাবনা কম থাকে ।

(খ) ডিভিশন (Division of clumps)

মাতৃগাছের ক্লাম্প বিভক্ত করে বংশবৃদ্ধি করা যায়। এ জন্য মাঠের সুপ্রতিষ্ঠিত ও পরিপূর্ণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গাছগুলিকে ছোট ছোট ভাগে ধারালো ছুরি দিয়ে ভাগ করা হয়। উক্ত সাকার (Sucker) গুলির পাতা ও শিকড় হালকা প্রনিং (Pruning) করে পরবর্তীতে নতুন বেডে (Bed) লাগানো হয়।

(গ) মাইক্রোপ্রোপাগেশন (Micro propagation)

বানিজ্যিক ভাবে চাষাবাদের ক্ষেত্রে উপরের পদ্ধতি দুটি খুব উপযোগী নয়। অল্প সময়ে প্রচুর সংখ্যায় রোগমুক্ত জারবেরার চারা পাওয়ার জন্য টিসুকালচার পদ্ধতিটি উত্তম। এ জন্য প্রথমে সঠিক জাত নির্বাচন করতে হবে। পরে ঐ গাছের কান্ডের বর্ধিত অগ্রাংশ (growing shoot tips), ফুল কুঁড়ি (Flower bud), পাতা (Leaf) ইত্যাদিকে এক্সপ্লান্ট (Explants) হিসাবে নিয়ে বার বার সাব-কালচার (Sub-culture) করে অসংখ্য চারা উৎপাদন করা সম্ভব।

চাষাবাদ (Cultivation)

(ক) জমি তৈরী (Land preparation)

জমিতে পরিমানমত জৈব সার দিতে হবে। তারপর ৪০-৪৫ সেঃ মিঃ গভীর করে আড়াআড়ি ও লম্বা ভাবে পরপর কয়েকটি চাষ দিয়ে জমিটি ঝুরঝুরা (fine tilth) করে তৈরী করতে হবে। ফলে সকল জৈব সার মাটির সাথে সুন্দরভাবে মিশে যাবে

(খ) বেড তৈরী (Bed preparation)

জারবেরার জন্য বেডের উচ্চতা ২০ সেঃ মিঃ এবং প্রশস্ততা ১.০-১.২ মিঃ হলে ভাল হয়। জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেজন্য দুই বেডের মধ্যবর্তী ৫০ সেঃ মিঃ পানি নিষ্কাশন নালা থাকতে হবে। সাধারনতঃ একবার লাগিয়ে পর্যায়ক্রমে ২ বৎসর ফুল আহরন করা হয় বলে জমি ও বেড তৈরীর সময়   সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়।

(গ) চারা লাগানো (Planting)

বেড (Bed) তৈরী হলে জাত ও এর বৃদ্ধির ধরন বুঝে সাকারগুলি (Sucker) সারি থেকে সারি ৫০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছ ৪০ সেমি দূরত্ব রেখে রোপন করতে হবে। চারাগুলি এমনভাবে মাটিতে স্থাপন করতে হবে যেন চারার ক্রাউন (Crown or Central growing point) মাটির (Surface level) উপরে থাকে । ক্রাউন মাটির নীচে গেলে গোড়া পচা (Foot rot) রোগ সংক্রমনের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়।

(ঘ) লাগানোর সময় (Planting time)

জারবেরা সারা বৎসর লাগানো যায় তবে উন্নত ফুল ও বেশী উৎপাদন পেতে সাধারনতঃ অক্টোবর-নভেম্বর  মাসে চারা লাগানো উচিত।

(ঙ) পানি দেয়া (Irrigation)

জারবেরার শিকড় গভীরে প্রবেশ করে বিধায় বার বার হালকা স্প্রিংকলার (Sprinkler) সেচের পরিবর্তে প্লাবন সেচ (Flood Irrigation) দেয়া উত্তম। পানি সেচের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়। কারণ জারবেরা ক্ষেতে জলাবদ্ধতা মাটিবাহিত রোগ সংক্রমণ ত¦রানি¦ত করে। আবার মাটিতে পানির অভাব হলে গাছ ঢলে (Wilting) পড়ে, সেক্ষেত্রে ফুলের পুষ্পদন্ড ছোট হয়ে যায়। বায়ু চলাচলের সুবিধার জন্য প্রতিবার সেচ দেয়ার পর মাটিতে জো  আসলে নিড়ানী দিয়ে উপরের শক্ত আস্তরণ (Hard crust)  ভেঙ্গে দিতে হবে।

(চ) সার প্রয়োগ (Fertilization)

জারবেরা দ্রুত বর্ধনশীল একটি ফুল ফসল। গাছের বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ ও গাছ থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে পরিমিত পরিমান সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা লাগানোর পর নতুন শিকড় গজানো শুরু হলে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।

জারবেরাতে সার প্রয়োগের মাত্রা হেক্টর প্রতি নিম্নরূপ:

সারের নাম পরিমাণ/হেক্টর       সাকার রোপণের ১০-১৫ দিন পূর্বে সাকার রোপণের ৭-১০ দিন পূর্বে রোপণের প্রায় ২০ দিন পরে রোপণের ৪৫ দিন পর
পচা গোবর/কম্পোস্ট ১০,০০০ কেজি সবটুকু
কোকোডাস্ট ২,০০০ কেজি সবটুকু
ইউরিয়া ৩৫০ কেজি অর্ধেক অর্ধেক
টিএসপি ২৫০ কেজি সবটুকু
এমওপি ৩০০ কেজি সবটুকু
জিপসাম ১৬৫ কেজি সবটুকু
বোরিক এসিড ১২ কেজি সবটুকু
জিংক অক্সাইড ৪ কেজি সবটুকু

গোবর/কম্পোস্ট অন্তত ১০-১৫ দিন পূর্বে এবং টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, বোরিক এসিড, জিংক অক্সাইড সাকার রোপণের ৭-১০ দিন পূর্র্বে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। রোপণের প্রায় ২০ দিন পরে ইউরিয়া সারের অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার রোপণের ৪৫ দিন পর গাছের গোড়ার চারপাশে একুট দূর দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। উপরি প্রয়োগের পর সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ প্রদান করতে হবে।

রোগ ও পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনাঃ

পাতায় দাগ রোগঃ

গাছের পাতায় অল্টারনারিয়ার মতো এবং পোড়া দাগ দেখা যায়। এ রোগের আক্রমণে ধীরে ধীরে পুরো পাতায় দাগ ছড়িয়ে পরে।

প্রতিকারঃ

১। কনটাফ ৫ ইসি ১ মিলি/ লিটার পানিতে দিয়ে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।

মূল পচা রোগঃ

মাটি বাহিত এক প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে এরোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত হলে  গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়এবং অবশেষে সম্পূর্ণ গাছটি শুকিয়ে যায়। মাটি জীবাণুমুক্ত করে চারা লাগালে এ রোগ কম হয়।

গোড়া পচা রোগঃ

এটি মাটি বাহিত রোগ। এ রোগের ফলে গাছের কেন্দ্রীয় অংশ প্রথমে কালো রং ধারণ করে ও পরে পচে যায়। পরবর্তীতে পাতা ও ফুল মারা যায়।

প্রতিকার

১. রিডোমিল গোল্ড অথবা ডায়থেন এম-৪৫ ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম/লিটার পানিতে  ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

২. টপসিন ০.০৫% হারে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করেও এ রোগ দমন করা যায়।

পাউডারি মিলডিউ

দুই ধরনের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। এ রোগে আক্রান্ত গাছেরর উপরে  সাদা পাউডারের আস্তরণ দেখা যায়।

প্রতিকার

১। কম্প্যানিয়ন ২ গ্রাম/লিটার অথবা অটোস্টিন ২ গ্রাম/লিটার অথবা বেনোমিল ৫০ডব্লিউপি ২ গ্রাম/লিটার পানিতে স্প্রে করতে হয়।

পোকামাকড়

মাকড়/মাইট

শুস্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় মাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়। এর আক্রমণে পাতা ও ফুলকুঁড়ির বৃদ্ধি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফুলের অস্বাভাবিক আকার ও আকৃতির কারণে বাজার মুল্য থাকে না।

প্রতিকার

১. আক্রমনের প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

২. যেকোন মাকড়নাশক যেমন সানমেকটিন ১.২ মিলি/লিটার বা ভারটিম্যাক বা ওমাইট ৫৭ইসি ১.৫ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।

সাদা মাছি পোকা

সাদা মাছি গাছের বিভিন্ন অংশের রস চুষে মারাত্মক ক্ষতি করে। এ পোকা ভাইরাস রোগ ছড়ায়।

দমন

১. আঁঠালো হলুদ রংয়ের ফাঁদ ব্যবহার করা ।

২. ৫০ গ্রাম আধা ভাঙা নিম বীজ ১ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি ছেকে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার পাতার নীচের দিকে স্প্রে করা।

৩. চারা রোপনের ১০-১৫ দিন পর থেকে এসাটাপ ৭৫ (এসপি) ও কুমুলাস ডিএফ এক সঙ্গে ২ গ্রাম করে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।

ফুল তোলা (Harvesting)

জারবেরা ফুলের বাহিরের দুসারি ডিস্ক ফ্লোরেট পুষ্পদন্ডের সাথে সমকৌণিক অবস্থানে আসলে ফুল তোলা হয়। কর্তনের সময় পুষ্পদন্ড যথাসম্ভব লম্বা রেখে ফুল সংগ্রহ করা হয়। ধারালো চাকু দ্বারা তেরছা ভাবে কেটে খুব সকালে বা বিকেলে ফুল সংগ্রহ উত্তম। ফুল কাটার পর পুষ্পদন্ড এক ইঞ্চি পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। পানির সঙ্গে অল্প চিনি এবং কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে দিলে ফুল সতেজ থাকে।

ফলন (Yield)

জাত ভেদে ফলন কম বেশি হয়। তবে প্রতি গাছে ২০-২৫ টি ফুল বছরে সংগ্রহ করা যায়।

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত