ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার, এর উন্নয়ন এবং কৌশলসমূহ
ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার (CSA) কথাটি প্রথম উত্থাপিত হয় ২০১০ সালে কৃষি, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক কনফারেন্সে।
climate smart agriculture বা জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষি হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যা টেকসই কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ফসলের অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো হ্রাসকরণ/নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং উন্নয়নের লক্ষ্য নিশ্চিত বুঝায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এর সংজ্ঞায়িত ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার তিনটি স্তম্ভের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে:
১। টেকসই কৃষি ও শস্যের উৎপাদনশীলতা এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি করণ।
২। CSA জলবায়ু পরিবর্তনকে মানিয়ে নেয় এবং স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি করে।
৩। যেখানে সম্ভব সেখানে, কৃষি ক্ষেত্রে গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমতা কমিয়ে দেয় এমনকি অপসারণও করে।
CSA মোটেও একটি একক নির্দিষ্ট কৃষি কারিগরী প্রকৌশল বা অনুশীলন নয় যা সর্বজনীনভাবে সকল ক্ষেত্রেই ব্যবহারযোগ্য। CSA ধারণাটি অধুনাকালে নতুন হলেও এর তিনটি স্তম্ভকে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এর অনুশীলন মোটেও নতুন নয়। তবে ক্লাইমেট স্মার্ট ধারণাটি কৃষকের কাছে অবশ্যই পরিচিত নয়।
CSA এর আসলে তেমন কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে এই পদ্ধতি টেকসই কৃষির কৌশল যেমন: Argo-forestry, Conservation Agriculture, Integrated-Livestock Systems, Improve Water Management, Weather forecasting অথবা Risk Insurances কোন ধারণাকেই এই সংজ্ঞা থেকে বাদ দেয়া হয়নি। যদিও CSA এর এই ধারণাটি বহুলভাবে সমালোচিত হয়েছে।
তারপরেও এই ধারণাটিকে জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সি যেমন: জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভলপমেন্ট, পরিবেশ কর্মসূচি, বিশ্ব ব্যাংক এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি এই ধারণাকে উন্নীত করছে। এছাড়াও অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে Consultative Group for International Agriculture Research (CGIAR) তাদের বিভিন্ন কৃষি নীতিমালায় এ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে ।
CSA কাদের জন্য প্রযোজ্যঃ FAO উল্লেখ করেছে যে, কৃষিতে CSA এমনি একটি পদ্ধতি যা মূলত উন্নয়নশীল দেশ এবং ক্ষুদ্র কৃষকের জন্যই প্রণিত হয়েছে। কিন্তু FAO এটিও দাবী করে যে, CSA এর নীতিমালা সমভাবে উন্নত দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য অর্থাৎ যেখানে উন্নয়নশীল দেশের মতোই যে দেশগুলো কৃষিতে গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমণ, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকী ও জনসংখ্যার বিস্ফোরণে আক্রান্ত।
পরিবর্তিত জলবায়ু উপযোগী কৃষি (climate resilient agriculture)ঃ বলতে অভিযোজন ও ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং সর্বস্তরে উপযোগী জীববৈচিত্র্য আনায়ন ইত্যাদি বোঝায় যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করে টেকসই কৃষির উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর ধারাবাহিক অসামঞ্জস্যতা বাংলাদেশের কৃষির সামনে একটি প্রধান সমস্যা হতে চলেছে। তাপমাত্রার ক্রমবৃদ্ধির ফলে অনেক ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে অন্য দিকে আগাছা, রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অঞ্চলভেদে সেচের মাধ্যমে আবাদকৃত ফসলের উৎপাদন হ্রাস পাবে যার কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং মাটিতে পানির সহজলভ্যতার পরিবর্তন। ফসলের উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণভাবে কমে যাচ্ছে এর কারণ উৎপাদন মৌসুমের স্থায়ীকাল হ্রাস; যার ফলে ফসলের বংশবৃদ্ধি এবং দানা গঠনের ওপর প্রভাব ফেলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফসলের (যেমনঃ ধান, ভুট্টা, আলু, ফুল,নারিকেল, লেবু জাতীয় ফল, পেয়ারা, লিচু, পেঁপে ইত্যাদির) ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
climate smart agriculture বা জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষি নিশ্চিত করতে হলে আমাদের কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে যার মধ্যে থাকবে উপযুক্ত নীতিমালা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং কৃষি কাজে নিয়োজিত তথ্যসমৃদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় সম্পদশালী জনগোষ্ঠী।
কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সপ্তম ডি-৮ সম্মেলনঃ ১২-১৩ জানুয়ারি, ২০২২ খ্রিঃ কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা শীর্ষক ৭ম ডি-৮ মন্ত্রীপর্যায়ের ভার্চুয়াল সভার মূল আলোচনার বিষয় হলো কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা: ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষির উন্নয়ন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে (বিএআরসি) কৃষি মন্ত্রণালয় কতৃক আয়োজিত দুদিনব্যাপী কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা শীর্ষক ৭ম ডি-৮ মন্ত্রীপর্যায়ের ভার্চুয়াল সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি।
ক্লাইমেট স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়নে ‘বহুদেশীয় সমন্বিত প্রকল্প’ নিতে বাংলাদেশের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে উন্নয়নশীল আটটি দেশের জোট ডি-৮।
প্রকল্পের অধীনে যৌথ গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ করা হবে। আইডিবি, এফএও, ইরি, ইফাদসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে এবং খুব শিগগির প্রকল্প প্রণয়নের কাজ শুরু হবে।
এছাড়াও জোটভুক্ত দেশসমূহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেমন- কৃষির উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে করণীয়, যৌথ কৃষি গবেষণা, যান্ত্রিকীকরণ, এগ্রো-প্রসেসিং, ব্লু ইকোনমি, সার উৎপাদন, বীজ, অ্যানিমেল ফিড, ভ্যালু চেইন উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষির (climate smart agriculture) কৌশলঃ কৃষি উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ানোই এ কৌশলের মূলমন্ত্র। অতিরিক্ত পানি, সার এবং অন্যান্য এগ্রো কেমিক্যালস ইত্যাদির ব্যবহার কমিয়ে উপকরণাদি ব্যবহারের দক্ষতা অবশ্যই বাড়াতে হবে। অর্থাৎ কম কৃষি উপকরণ ব্যবহার করে অধিক উৎপাদনের কৌশল নিতে হবে।
টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থাপনার জন্য পানি সংরক্ষণ এবং সংগ্রহ উদ্যোগ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন ও তার সঙ্গে যৌথভাবে সার ব্যবস্থাপনা এবং সার্বিকভাবে উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতার ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। স্বল্প সময়ের ফসলের (short duration crops) জাতগুলো যা খরা সহিষ্ণু এবং উদ্যান ফসলগুলো যাদের বিস্তৃত অভিযোজন ক্ষমতা রয়েছে, সেগুলো চাষের ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। উপযুক্ত আদিজোড় (root stalk) বহুবর্ষী ফলজাতীয় ফসলের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
ফসলের জন্য টেকনোলজি অ্যাসেসমন্টে মডিউল গুলো-
নিম্নেবর্ণিত টেকনোলজি অ্যাসেসমন্টে মডিউলগুলো (technology assessment modules) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য যুক্ত করা যেতে পারে।
ক. মডিউল-১ : প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা : মাটির স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো তথা ইনসিটো আর্দ্রতা সংরক্ষণ, পানি ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ করা এবং তা ব্যবহার, বন্যাপ্রবণ এলাকায় উন্নত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাপনা, প্রচলিত কর্ষণ ব্যবস্থাপনা (conservation tillage)। ড্রিপ ইরিগেশন শুধু পানি ও পুষ্টিই সাশ্রয় করে না বরং মাটির স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধান করে।
খ. মডিউল-২ : শস্য উৎপাদন : খরা/তাপ সহিষ্ণু জাতগুলো, যেসব অঞ্চলে আগাম খরা/তাপ আসে সেখানে আগাম রবি ফসল আবাদ, পানি সাশ্রয়ী ধান চাষ পদ্ধতি যেমন-এসআরআই (system of rice intensification) ও সরাসরি বপন, উদ্যান ফসলে ফিউমিগেশনের মাধ্যমে কুয়াশা ব্যবস্থাপনা, নাবী মৌসুমের জন্য কমিউনিটি নার্সারি সিস্টেম, যথাসময়ে ফসল রোপণের জন্য কাস্টম হায়ারিং সিস্টেম (custom hiring centers), অঞ্চল বিশেষে বিশেষ বিশেষ আন্তঃফসল চাষ ইত্যাদিও ভালোভাবে পরীক্ষিত জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী কৃষি ব্যবস্থাপনা।
কনজারভেশন কৃষি (conservation agriculture) পদ্ধতি ক্রমাগতভাবে টেকসই কৃষি এবং জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী কৃষি হিসেবে ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনটি প্রধান উপাদান দ্বারা গঠিত ১. ভূমি কর্ষণ হ্রাস, ২. শস্য পরিত্যক্ত অংশ মাটিতে সংযুক্ত করা এবং ৩. শস্য বহুমুখীকরণ (শস্যাবর্তন, আন্তঃফসল চাষ, রিলে ক্রপিং ইত্যাদি)। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার জন্য নাইট্রোজেন সার ব্যবহার দক্ষতা বাড়াতে হবে।
শুষ্কভূমির কৃষি, তথ্যাধিকার, জৈবপ্রযুক্তি এবং ঝুঁকি মোকাবেলা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস (মাঝারি সীমার আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ) এবং বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অন্যান্য তথ্যসমূহ যেমন খরা যার ফলে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা নিতে পারি।
গ্রামীণ/খামার পর্যায়ে জলবায়ু সুসামঞ্জস্য কৃষি (climate smart agriculture) সিস্টেমের প্রধান উপাদানগুলোঃ
ওয়াটার স্মার্ট: বৃষ্টির পানি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার, পানির সামাজিক ব্যবস্থাপনা, খামারে পানির ব্যবস্থাপনা।
কার্বন স্মার্ট: প্রচলিত কর্ষণ পদ্ধতি, ভূমি ব্যবহার পদ্ধতি, গবাদিপশু ব্যবস্থাপনা।
নাইট্রোজেন স্মার্ট: পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, যুক্তিসংগত সার ব্যবহার, আন্তঃফসল হিসেবে লিগিউম জাতীয় ফসল চাষ।
অ্যানারজি স্মার্ট: জৈব-জ্বালানি, জ্বালানি সাশ্রয়ী ইঞ্জিন, বর্জ ব্যবস্থাপনা, ন্যূনতম কর্ষণ।
নলেজ স্মার্ট: কৃষক-কৃষক শিক্ষা পদ্ধতি, অভিযোজন টেকনোলজির জন্য কৃষক নেটওয়ার্ক, বীজ ও গোখাদ্য ব্যাংক, কিচেন গার্ডেন/বসতবাড়ির বাগান।
বাংলাদেশে বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে খাদ্য চাহিদা প্রকারান্তরে কমছে আবাদি জমির পরিমাণ। এর সাথে যোগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। এমতাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী কৃষির জন্য সঠিক ব্যবস্থপনার কোনো বিকল্প নেই।
তাই জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী কৃষির জন্য বাংলাদেশে কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপযোগী কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন, শস্য বহুমুখীকরণ ব্যবস্থাপনা এবং সাবধানতার সাথে আনুসঙ্গিক অন্যান্য শস্য ব্যবস্থাপনার ওপর অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!