জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতিতে সবজি চাষ
ভাসমান ধাপ পদ্ধতি কি ?
জলাবদ্ধ বা বন্যাকবলিত এলাকায় সারাবছর নিচু জমিতে জোয়ার ভাটার কারণে পানি জমে থাকায় বছরের পর বছর জুড়ে এসব পতিত জমিতে কুচুরিপানা, দুলালীবন, শেওলা ও ফেনা ঘাসে ভরা থাকত। তারা জমিতে চাষাবাদ করতে পারতেন না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কৃষকেরা এসব কুচুরিপানাকে ধাপে ধাপে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করেন। এরপর সেসব ধাপের উপর শ্যাওলা, দুলালীলতা, টোপাপানা, কুটিপানা, কলমিলতা, জলজ লতা স্তরে স্তরে সাজিয়ে ২-৩ ফুট পুরু করে ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করে ফসল উৎপাদনে সফল হোন। কৃষকদের নিজেদের বাঁচার তাগিদে উদ্ভাবনকৃত এই পদ্ধতিই হলো ভাসমান বা ধাপ পদ্ধতি।
বরিশাল, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুর, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ জেলাগুলোতে ভাসমান ধাপে পদ্ধতিতে শাক-সবজিসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা যায়।
আমরা কিভাবে ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করব?
আষাঢ়- শ্রাবণ মাস ( মধ্য জুন- মধ্য আগস্ট ) ভাসমান বেড তৈরি করার উপযুক্ত সময়। তবে এলাকা ভেদে জ্যৈষ্ঠ-কার্তিক মাস পর্যন্ত ভাসমান বেড তৈরি করে সবজি লাগানো যায়।
ভাসমান ধাপ তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে-কচুরীপানা। আষাঢ় মাসে কচুরিপানা সংগ্রহ করে স্তূপ করা হয়। একেকটি ভাসমান বেড ২০- ৬০ মিটার লম্বা, ২ মিটার প্রশস্ত এবং ১ মিটারের কাছাকাছি উঁচু করে তৈরি করতে হয়। এরপর বেডের উপর কচুরিপানা এবং পর্যায়ক্রমে শ্যাওলা, দুলালীলতা, টেপাপানা, কুটিপানা, নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া ও ক্ষুদ্রাকৃতির বিভিন্ন ধরনের জলজ উদ্ভিদ পচিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়। ধাপ দ্রুত পচানোর জন্য সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। এ ধাপ চাষের উপযোগী করতে ৭-১০ দিন সময় লাগে। ভাসমান বীজতলাগুলো যাতে ভেসে না যায়, সেজন্য শক্ত বাঁশের খুটির সাহায্যে বেঁধে রাখতে হয়।
ভাসমান পদ্ধতিতে সরাসরি বীজ বপন না করে কৃষকরা প্রতিটি বীজের জন্য দৌলা বা মেডা তৈরি করেন। একমুঠো আধা পচা টেপাপানা বা ছোট কচুরিপানা, দুলালীলতা দিয়ে পেচিয়ে বলের মতো করে তার মধ্যে নারিকেল ছোবড়ার গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় দৌলা। সাধারণত নারীরা দৌলা তৈরির কাজ করেন। প্রতিটি দৌলার মধ্যে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে গর্ত করে বিভিন্ন সবজির অঙ্কুরিত বীজ পুঁতে দেওয়া হয়। দৌলাগুলো লাইন করে রাখার ৭-১০ দিন পর গজানো চারাগুলো ভালোভাবে বেরিয়ে আসলে ধাপে স্থানান্তর করা হয়। চারাগুলো পরিপক্ব চারায় পরিণত হতে সময় লাগে ২০- ২৫ দিন।
ভাসমান পদ্ধতিতে ঢেঁড়স, বরবটি, ঝিঙ্গে, শসা, করলা, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, ডাটা,পুঁইশাক, চাল কুমড়া, পালংশাক, লালশাক, ধনেপাতা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, ব্রোকলি, মুলা, গাজর, টমেটো, লাউ, বেগুন, মরিচসহ অন্যান্য ফসল চাষ করা যায়।
আপনি কি মনে করেন ভাসমান ধাপ পদ্ধতিতে সবজি চাষ লাভজনক?
বন্যা ও জলাবদ্ধ এলাকায় বছরে প্রায় ০৬ মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে। এ সময় সেখানে কোনো কৃষি কাজ থাকে না, ফসল হয় না, মানুষ বেকার জীবন-যাপন করে। এমতাবস্থায়, ভাসমান পদ্ধতিতে নিচু ও পতিত জলাবদ্ধ অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় এনে সারাবছর সবজি, অন্যান্য ফসল ও চারা উৎপাদন করা যায়। বীজতলায় সেচের দরকার হয় না, সারের পরিমাণ কম লাগে এবং বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করা যায়। মৌসুম শেষে ধাপ পচিয়ে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার উৎপাদন করা যায়। এ পদ্ধতিতে কৃষক ভাইয়েরা ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে বহুমাত্রিক কৃষিকাজ করে অল্প সময়ে কাঙ্ক্ষিত ফলন পেয়ে অধিকতর লাভবান হতে পারবেন। তাই ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি চাষ অবশ্যই একটি পরিবেশ বান্ধব ও লাভজনক প্রযুক্তি বলে আমি মনে করি।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!