টার্কি মুরগির বাচ্চা পালন পদ্ধতি, আদর্শ খাবার এবং নিয়ম
দ্বিতীয় খণ্ড
টার্কি মুরগির বাচ্চা পালন পদ্ধতিঃ
- টার্কি মুরগির বাচ্চার ঘরে ঠিকমতো তাপ দিতে হবে। যদি স্টোভে গরম করার ব্যবস্থা থাকে তবে দেখতে হবে স্টোভে বা ল্যাম্পে কোন গন্ডগোল আছে কিনা। কোন কারণে যেন বাচ্চারা উত্তপ্ত আলোর কাছে পৌছাতে না পারে-সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ঘরে অবশ্যই স্যাতসেতে ভাব থাকা যাবে না। এটা এড়ানোর জন্য বাচ্চার ঘরে পুরুস্তরের বিছানা (Deep litter) বিছাতে হবে।
- বাচ্চারা যেন বিছানার বিচুলি (খড়) খাওয়ার অভ্যাস না করে। বাচ্চারা ১ দিনের হলে বাচ্চাদের খাবার দিতে হবে শক্ত পিচবোর্ডের ওপর। কিছুটা বড় টার্কিদের জন্য খাবারের জায়গা (Chick hoppers) সবসময় যেন খাবারে ভর্তি থাকে। পরীক্ষিত এবং ব্রুডিংদের সুষম খাবার দিতে হবে।
- বায়ু/বাতাস চলাচলের সুব্যবস্থা রাখতে হবে।
- বাচ্চাদের বয়স ৪-৬ সপ্তাহ হলে ওদের দাড়ে বসানো অভ্যাস করতে হবে। বাচ্চাদের খুব তাড়াতাড়ি দাড়ে বসা অভ্যাস করালে মেঝেতে ভিড় কমবে। সেই সাথে বিছানা থেকে তৈরি রোগ ব্যাধির হাত থেকেও মুক্ত থাকবে।
- বাচ্চাদের সামনে পরিষ্কার মোটামুটি ঠান্ডা পানি দিনে অন্তত দুই বার রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
- বাচ্চা তিন সপ্তাহের বেশি বয়স হয়ে গেলে ওদের কুচানে ঘাস দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
- প্রতিদিন বাচ্চার ঘর খাবার এবং পানির পাত্রসহ পরিষ্কার করতে হবে।
- নিয়মিত বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় টিকা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে।
- সবসময় বাচ্চার ঘর যেন বাচ্চাদের ভীড়ে ভরাট না থাকে। ভীড় হলে বাচ্চা বাড়বে কম এবং মারাত্নক ব্যাধির সম্ভাবনা বাড়বে।
- বাচ্চা ঘর এমন জায়গায় করতে হবে যেন ঠান্ডা বাতাস এবং বৃষ্টি বাচ্চাদের ব্যতিব্যস্ত করে না তোলো।
- প্রতিদিন বাচ্চাদের পরিদর্শন করতে হবে। দিনে যতবার বেশি পারেন তত ভালো। লক্ষ্য করতে হবে কোন অস্বভাবিকতা দেখা যায় কিনা। সবসময়ে পশু চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
- বাচ্চাদের ব্রুডিং ঘরে আনবার আগে একবার ঘরের আসবাব, তাপমান যন্ত্র, পানি এবং খাবারের জায়গাগুলি ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে। কোন অসামঞ্জস্য বা ক্রুটি থাকলে সেটা অবশ্যই ঠিক করে নিতে হবে।
- ঠোকরান ও মারামারি থেকে মাথায় আঘাত লাগা আটকাতে স্নুড বা ডিউবিল (ঠোঁটের গোড়ায় মাংসল পিণ্ড) সরিয়ে ফেলা হয়৷ এক দিন বয়সে আঙুলের চাপ দিয়ে স্নুডতুলে ফেলা যায়৷ ৩ সপ্তাহ বয়সে তা ধারাল কাঁচি দিয়ে মাথার একেবারে কাছাকাছি কেটে ফেলা যায়৷
- টার্কি বাচ্চা ফুটার পর নাভি শুকানোর জন্য” কসোমিক্সপ্লাস” ৩ দিন পানির সাথে দিতে হবে। এতে মৃত্যুহার কম হবে এবং এটি বেশ কার্যকারী।
টার্কি মুরগীর আদর্শ খাবার এবং নিয়মঃ
সবুজ খাবারঃ সব সময় মোট খাবারের সঙ্গে ৫০% সবুজ ঘাস খেতে দিলে ভালো । সে ক্ষেত্রে নরম জাতীয় যে কোন ঘাস হতে হবে । যেমন – কলমি, হেলেঞ্চা ইত্যাদি । একটি পূর্ণ বয়স্ক টার্কির দিনে ১৪০ – ১৫০ গ্রাম খাবার দরকার হয় । যেখানে ৪৪০০ – ৪৫০০ ক্যালোরি নিশ্চিত করতে হবে।
খাবারঃ টার্কির খাবার সরবরাহের জন্য দুইটি পদ্ধতি ব্যাবহার করা যায় । যেমন ম্যাশ ফিডিং ও পিলেট ফিডিং । একটি আদর্শ খাদ্য তালিকা নিচে দেয়া হলো –
উপাদান | হার |
ধান | ২০% |
গম | ২০% |
ভুট্টা | ২৫% |
সয়াবিন মিল | ১০% |
ঘাসের বীজ | ০৮% |
সূর্যমুখী বীজ | ১০% |
ঝিনুক গুড়া | ০৭% |
মোট | ১০০% |
বিঃ দ্রঃ অন্যান্য পাখির তুলনায় টার্কির জন্য বেশি ভিটামিন, প্রোটিন, মিনারেলস দিতে হয়। কোন ভাবেই মাটিতে খাবার সরবরাহ করা যাবে না। সবসময় পরিষ্কার পানি দিতে হবে।
টার্কির খাবার দেওয়ার পদ্ধতিগুলিঃ
- মুরগির তুলনায় টার্কির শক্তি, প্রোটিন ও খনিজের প্রয়োজন বেশি।
- যেহেতু পুরুষ ও মাদীর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শক্তির (এনার্জি) পরিমাণ আলাদা। তাই ভালো ফলাফল পাওয়ার জন্য তাদের পৃথক ভাবে পালন করতে হবে।
- খাবার মাটিতে নয়, ফীডারে দিতে হবে।
- এক রকম খাবার থেকে অন্য খাবারের পরিবর্তন আস্তে আস্তে করতে হবে।
- টার্কিদের সব সময় অবিরাম পরিষ্কার পানির জোগান দিতে হবে।
- গ্রীষ্মকালে আরও বেশি সংখ্যায় পানি রাখতে হবে।
- গ্রীষ্মকালে দিনের অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা সময়ে টার্কিদের খাবার দিতে হবে।
- পায়ের দুর্বলতা এড়াতে দিনে 30-40 গ্রা.হারে ঝিনুকের খোলের গুঁড়ো দিতে হবে।
ডিম উৎপাদনঃ সাধারণত ৩০ সপ্তাহ বয়স থেকে টার্কি ডিম দেওয়া শুরু করে । প্রয়োজনীয় আলো বাতাস, পরিষ্কার পানি এবং খাবার সরবরাহ করা হলে বসরে ৮০ – ১০০ টি ডিম দিয়ে থাকে। ৬০ – ৭০ শতাংশ টার্কি মুরগি বিকেল বেলায় ডিম দেয় ।
টার্কির ডিমঃ লেয়ার টার্কির খামার স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো লাভজনকভাবে ডিম উৎপাদন করা। এ জন্য দরকার একটি টার্কির উৎপাদন সক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশ বা প্রদর্শনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নানাবিধ কারণে কোন একটি টার্কির ফ্লক থেকে যে পরিমান ডিম পাওয়ার কথা অনেক সময় তা পাওয়া যায় না। আপনার খামারে যদি ১০০ ডিম পাড়া টার্কি থাকে তাহলে ঐ টার্কি থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনকালীন সময়ে বা ২২ সপ্তাহ বা ২৫ সপ্তাহ বা ৫০ সপ্তাহ বয়সে যে পরিমাণ ডিম পাওয়ার কথা তা যদি না পাওয়া যায় তাহলে ধরে নিতে হবে কোথাও কোন সমস্যা রয়েছে।
যেসব কারণে কোন খামারে ডিম উৎপাদন কমে যায় বা বন্ধ হয়ে যেতে পারে তা হলো-টার্কির বয়স, জাত, পুষ্টি, পীড়ন, দিনের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। একটি টার্কি দিনে একটিই ডিম পাড়বে। ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি বা বাড়ানোর কৌশল মানে একটি টার্কি থেকে দিনে একটির বেশি ডিম পাওয়া নয়। ডিম পাড়া শুরু করলে সপ্তাহে এক বা দু’দিন ডিম পাড়া বন্ধ থাকে। এ কারণে উৎপাদন কম হয়। যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো টার্কি ও ডিমের অনুপাত কমিয়ে রাখা। অর্থাৎ যখন টার্কি থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমান ডিম পাওয়া যাবে না তখন যে বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রথমেই অনুসন্ধান করতে হবে তা হলো-
আলোঃ আমরা জানি টার্কির যৌন পরিপক্কতায় আসা এবং ডিম উৎপাদনের উপর আলোর প্রভাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যখন দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকে তখন টার্কি ডিম বেশি পাড়ে। ডিমপাড়া টার্কির জন্য দৈনিক ১৪ ঘণ্টার বেশি দিনের আলো দরকার। শীতকালে টার্কির ডিম উৎপাদন কমে যাওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো দিনের দৈর্ঘ্য কম হওয়া। তবে আধুনিক বাণিজ্যিক টার্কি খামারে কৃত্রিম আলো প্রদানের মাধ্যমে টার্কির ডিমপাড়ার জন্য আলোক ঘণ্টা তৈরি করা হয়। বাণিজ্যিক লেয়ার টার্কির খামারে একজন অভিজ্ঞ ও সচেতন খামারি টার্কির ঘরে কৃত্রিম আলোক ঘণ্টা তৈরি করে ডিম উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে পারবেন।
লক্ষণীয় যে, পরিপূর্ণ আলোক কর্মসূচি না থাকায় শীতের শুরু থেকে বিশেষ করে অক্টোবর-নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ডিম পাড়া কমে যায় এবং এরপর থেকে আবার ডিম পাড়া শুরু করে। বাণিজ্যিক খামারে টার্কির ডিম উৎপাদনের হার কমে গেলে বা নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে ডিম পাড়া শুরু করলে টার্কি পালনকারি/খামারিকে এই সাধারণ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কারণ যখন দিনের দৈর্ঘ্য বেশি থাকে তখন উৎপাদনে আসে। পুলেট যখন ডিমপাড়া শুরু করে তখন আস্তে আস্তে আলোক ঘণ্টা বাড়াতে হবে। সারাবছর ধরে ডিম উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে আলোক প্রদান কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
পীড়নঃ পীড়নের কারণে টার্কির ডিমপাড়া কমে যায় এমন কি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যে সব কারণে টার্কিতে পীড়ন বা ধকল সৃষ্টি হয় তা হলো-
- যদি ডিমপাড়া টার্কির শেডের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা খুব বেশি বা কম হয়।
- যদি শেডে টার্কির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য পাত্র, পানির পাত্র সরবরাহ নিশ্চত করা না হয়।
- পরিবেশের উচ্চ তাপমাত্রা বা পরিবেশ প্রতিকুল হলে।
- ভ্যাক্সিনেশন, ঠোটকাটা বা ট্রিমিং, পরিবহন জনিত সময়ে পীড়ন সৃষ্টি হয়।
- খাদ্যের গুণগত মানের সমস্যা হলে, খাদ্যে টক্সিন এর উপস্থিতি।
- টার্কি হ্যান্ডলিং এর সময়।
- ভেনটিলেশন ব্যবস্থা ভালো না হলে।
- ব্যবহৃত লিটারের গুণগতমান ভালো না হলে।
- ক্লিনিক্যাল, সাবক্লিনিক্যাল বিভিন্ন রোগের কারণে টার্কিতে পীড়ন বা ধকল সৃষ্টি হয়।
- সরবরাহকৃত পানির গুণগতমান ভালো না হলে বা পানি দূষিত হলে পানি গ্রহণ কমে যায় এবং পানিবাহিত রোগ সংক্রমণ ঘটে এটাও এক ধরনের পীড়ন।
- টার্কির ঘরে আলোর তীব্রতাও পীড়নের কারণ। টার্কির ঘরে এ ধরনের ঘটনার উদ্ভব হলে তাৎক্ষণিক কার্যকর ব্যবস্থা করে টার্কির উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা যায়।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!