স্ট্রবেরি (Strawberry) চাষের আধুনিক কলাকৌশল ও বালাই ব্যবস্থাপনা
স্ট্রবেরি ( Strawberry ) একটি গুল্ম জাতীয় লতানো উদ্ভিদ। স্ট্রবেরির বৈজ্ঞানিক নাম (Fragaria ananasa) যা Rosaceae পরিবারভুক্ত। মৃদু শীত প্রধান দেশে এটি স্বল্প মেয়াদী ফল হিসেবে চাষ হয়। স্ট্রবেরি মূলত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফল হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি পড়ে ও অনেক দিন স্থায়ী হয় সেসব এলাকায় বারি স্ট্রবেরি-১ নামে একটি উচ্চফলনশীল জাতের স্ট্রবেরি চাষ করা হচ্ছে।
পুষ্টিমান ও ব্যবহারঃ স্ট্রবেরি অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি রসালো ফল। এ ফলে পানি, খাদ্যশক্তি, আমিষ, চর্বি, শর্করা, অশোধিত আঁশ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-সি, নিয়াসিন ও ভিটামিন-এ রয়েছে। ফল হিসেবে খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন খাদ্যের সৌন্দর্য ও সুগন্ধ বৃদ্ধিতেও স্ট্রবেরি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
স্ট্রবেরি গাছের বৈশিষ্ঠ্য:
- স্ট্রবেরি গাছ দেখতে অনেকটা থানকুনি বা আলুর গাছের মতো, তবে এ গাছের পাতা একটু বড় এবং চওড়া।
- স্ট্রবেরি গাছ ছোট ঝোপালো লতানো প্রকৃতির । এতে শক্ত কোনো কান্ড বা ডালপালা নেই।
- স্ট্রবেরি গাছের পাতা সবুজ, কিনারা খাঁজকাটা, পাতার বোঁটা লম্বা, সরু ও নরম।
- গাছে ছোট ছোট সাদা রঙের ফুল ফোটে। পরবর্তীতে সরু সুতার মতো বোঁটার মাথায় একটি একটি করে ফল ধরে।
- স্ট্রবেরি ফলটি কাঁচা অবস্থায় সবুজ কিন্তু পাকলে উজ্বল টকটকে লাল রঙের হয়। এ ফলটি দেখতে অনেকটা লিচুর মতো, স্বাদের দিক দিয়ে টক মিষ্টি এবং সুগন্ধীযুক্ত।
স্ট্রবেরির জাতঃ
জাতের নাম | উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম | চাষের সময় |
বারি স্ট্রবেরি-১, বারি স্ট্রবেরি-২, বারি স্ট্রবেরি-৩ | বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট | সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ |
রাবি-১, রাবি-২ এবং রাবি-৩ | রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় | সেপ্টেম্বর-অক্টোবর |
মর্ডান স্ট্রবেরি-১, মর্ডান স্ট্রবেরি- ২, মর্ডান স্ট্রবেরি- ৩, মর্ডান স্ট্রবেরি- ৪, মর্ডান স্ট্রবেরি-৫ | মর্ডান হর্টিকালচার সেন্টার, নাটোর | সেপ্টেম্বর-অক্টোবর |
উল্লিখিত জাতগুলোর মধ্যে নিম্নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত জাতগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো-
বারি স্ট্রবেরি-১ বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী একাট উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ প্রতি গড়ে ৩৭টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৭৪১ গ্রাম। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। নভেম্বারের মাঝামাঝি সময় ফুল আসতে শুরু করে এবং ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফল আহরণ করা যায়। গাছের গড় উচ্চতা ৩০ সেমি এবং বিস্তার ৪৫-৫০ সেমি। প্রতি গাছে ৩২ টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৪৫০ গ্রাম। হেক্টরপ্রতি ফলন ১০-১২ টন। হৃৎপিন্ডাকৃতির ফল ক্ষুদ্র থেকে মধ্যম আকারের যার গড় ওজন ১৪ গ্রাম। পাকা ফল আকষর্ণীয় টকটকে লাল বণের্র। ফলের তক্ব নরম ও ঈষৎ খসখসে। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। সুগন্ধযুক্ত ফলের স্বাদ টক-মিষ্টি ।
বারি স্ট্রবেরি-২ বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী একাট উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ প্রতি গড়ে ৩৭টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৭৪১ গ্রাম। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল দেখতে আকর্ষণীয় গাঢ় লাল রঙের, তুলনামূলক দৃঢ়, আকারে বেশ বড়, প্রান্তভাগ চ্যাপ্টা, রসালো, সুগন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি । ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি’ বিদ্যমান । ফল ২-৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
বারি স্ট্রবেরি-৩ বাংলাদেশের সর্বত্র চাষোপযোগী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ প্রতি গড়ে ৩৯ টি ফল ধরে যার মোট গড় ওজন ৭৭০ গ্রাম। ফলের শতভাগ ভক্ষণযোগ্য। ফল দেখতে আকর্ষনীয় লাল রঙের, লম্বা মোচাকৃতি, আকারে বেশ বড়, ফল তুলানামূলক দৃঢ়, প্রান্তভাগ সরু, রসালো, সুগন্ধযুক্ত এবং মিষ্টি। ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি বিদ্যমান। ফল ২-৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
উপযুক্ত মাটি ও আবহাওয়াঃ স্ট্রবেরি মূলত মৃদু শীত প্রধান অঞ্চলের ফসল। ফুল ও ফল আসার সময় শুকনো আবহাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের আবহাওয়া রবি মৌসুমে স্ট্রবেরি চাষের উপযোগী। বৃষ্টির পানি জমে না এ ধরনের ঊর্বর দোআঁশ থেকে বেলে-দোআঁশ মাটি স্ট্রবেরি চাষের জন্য উত্তম।
জমি তৈরিঃ জমি ভালভাবে চাষ করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে অন্তত ১ফুট গভীর করে জমি চাষ দিতে হবে। শেষ চাষের সময় পরিমানমতো সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। স্ট্রবেরি চাষে জমির পিএইচমান কম হলে জমিতে চুন দিয়ে জমির পিএইচ বাড়াতে হবে। স্ট্রবেরির জন্য মাটির পিএইচ মান ৬.০ থেকে ৭.০ হলে ভাল হয়।
স্ট্রবেরি চারা রোপনের সময়: স্ট্রবেরির চারা আশ্বিন (মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে মধ্য অক্টোবর) মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত স্ট্রবেরি চারা রোপণ করা যায়।
স্ট্রবেরির চারা রোপণঃ চারা রোপণের জন্য জমিতে বেড তৈরি করে নিতে হবে। এ জন্য ১ মিটার প্রশস্ত এবং ১৫-২০ সেমি উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। দুটি বেডের মাঝে ৪০-৫০ সেমি নালা রাখতে হবে। স্ট্রবেরি জমি তৈরির পর লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার এবং প্রতি সারিতে ৩০-৪০ সেন্টিমিটার পর পর স্ট্রবেরির চারা লাগাতে হয়। এভাবে চারা লাগালে প্রতি শতকে প্রায় ১৫০টি চারা রোপণ করা যায়। প্রতি সারির মাঝখানে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হয়।
সার প্রয়োগ: গুণগত মানসম্পন্ন উচ্চফলন পেতে হলে স্ট্রবেরির জমিতে শতক প্রতি নিম্নলিখিত পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে।
সারের নাম | পরিমাণ (প্রতি শতকে) |
ইউরিয়া | ১ কেজি |
টিএসপি | ৮০০ গ্রাম |
এমওপি | ৯০০ গ্রাম |
জিপসাম | ৬০০ গ্রাম |
শুকনা পচা গোবর | ১২০ কেজি |
শেষ চাষের সময় সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম ও অর্ধেক পরিমাণ এমওপি সার জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও অবশিষ্ট এমওপি সার চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১৫-২০ দিন পর পর ৪-৫টি কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচঃ জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে প্রয়োজনমতো পানি সেচ দিতে হবে। স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা একেবারে সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত বের করে দিতে হবে।
স্ট্রবেরির চারা উৎপাদনঃ স্ট্রবেরি রানারের (কচুর লতির মতো লতা) মাধ্যমে বংশবিস্তার করে থাকে। তাই পূর্ববর্তী বছরের গাছ নষ্ট না করে জমি থেকে তুলে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে। ওই গাছ থেকে উৎপন্ন রানারের শিকড় বের হলে তা কেটে ৫০ ভাগ গোবর ও ৫০ ভাগ পলিমাটিযুক্ত পলিথিন ব্যাগে লাগাতে হবে। এরপর পলিথিন ব্যাগসহ চারাটি হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। অতিরিক্ত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য চারার উপর পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে। রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই জাতের ফলন ক্ষতা অক্ষুন্ন রাথার জন্য টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্যবহার করা ভালো।
অন্যান্য পরিচর্যাঃ সরাসরি মাটির সংস্পর্শে আসলে স্ট্রবেরির ফল পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য চারা রোপণের ২০-২৫দিন পর স্ট্রবেরির বেড খড় বা কালো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলিলিটার ডার্সবান-২০ ইসি ও ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন ডিএফ মিশিয়ে ওই দ্রবণে খড় শোধন করে নিলে তাতে উঁই পোকার আক্রমণ হয় না এবং দীর্ঘ দিন তা অবিকৃত থাকে। জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছ লাগানোর পর তার গোড়া থেকে প্রচুর রানার বা কচুর লতির মতো লতা বের হতে থাকে। এগুলো জমি ঢেকে ফেলে। এতে ফলন ভাল হয় না। এ জন্য রানারসমূহ ১০-১৫ দিন পর পর কেটে ফেলতে হবে।
রোগ বালাই ব্যবস্থাপনা
পাতায় দাগ পড়া রোগঃ এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণে এই রোগ হয়। এই রোগের আক্রমণে ফলন ও ফলের গুণগত মান কমে যায়। এর প্রতিকারের জন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন-সিকিউর বা রিডোমিল্ড গোল্ড প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ফল পচা রোগঃ এ রোগের আক্রমণে ফলের গায়ে জলে ভেজা বাদামী বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়। দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়। এ জন্য ফল পরিপক্ক হওয়ার আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন-নোইন ৫০ ডব্লিউপি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মাকড়ঃ মাকড়ের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ও গুণগত মান মারত্মকভাবে বিঘিœত হয়। এদের আক্রমণে পাতা তামাটে বর্ণ ধারণ করে ও পুরু হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে কুচকে যায়। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যবহত হয়। এ জন্য ভারটিমেক নামক মাকড়নাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
পাখিঃ বুলবুলি পাখি স্ট্রবেরির সবচেয়ে বড় শত্রু। ফল আসার পর সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার আগেই পাখির উপদ্রব শুরু হয়। এজন্য ফল আসার পর সম্পূর্ণ বেড জাল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে পাখি ফল না খেতে পারে।
মাতৃগাছ রক্ষণাবেক্ষণঃ স্ট্রবেরি গাছ প্রখর সূর্যের আলো ও বেশি বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। এজন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ফল সংগ্রহের পর সুস্থ-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নিচে রোপণ করলে মাতৃগাছকে সূর্যের খরতাপ ও ভারী বৃষ্টির ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়। মাতৃগাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তী সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ফল সংগ্রহঃ ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি (অক্টোবর মাসের শুরু) সময়ে রোপণকৃত বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফল সংগ্রহ পৌষ মাসে শুরু হয়ে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে। ফল পেকে লাল রঙ হলে ফল সংগ্রহ করতে হয়। স্ট্রবেরির সংরক্ষণকাল খুব কম হওয়ায় ফল সংগ্রহের পর পরই তা টিস্যু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে প্লাস্টিকের ঝুড়ি বা ডিমের ট্রেতে এমনভাবে সংরক্ষণ করতে হবে যাতে ফল গাদাগাদি অবস্থায় না থাকে। ফল সংগ্রহের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করতে হবে।
ফলনঃ হেক্টরপ্রতি ৩৫-৪০ হাজার চারা রোপণ করা যায়। প্রতি গাছে ২৫০-৩০০ গ্রাম হিসেবে বারি স্ট্রবেরি-১ এর ফলন হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন।
চারা সংগ্রহ: স্ট্রবেরি চাষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো ভালো চারা সংগ্রহ করা। যেকোনো ভালো নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহ করা যেতে পারে। ৩০ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যেই ভালো চারা পাওয়া যায়। দাম তার চেয়েও কমবেশি হতে পারে। চারা ভালো না হলে তাতে ফল নাও আসতে পারে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), ব্র্যাক নার্সারি, সাভারের ফয়সাল নার্সারি, হরটারস নার্সারি, ঢাকার আগারগাঁও এ কৃষিবিদ নার্সারি, মোহাম্মাদপুর নার্সারিগুলোতে, কমলাপুর নার্সারিতে চারা পাওয়া যায়।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!