মাল্টা চাষ পদ্ধতি। বারি মাল্টা-১ এর বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পরিচর্যা
মাল্টা সাইট্রাস ফসলের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় ফল। মিষ্টি কমলা বা Sweet orange ( Citrus sinensis ) বাংলাদেশে মাল্টা নামে পরিচিত। কমলার সাথে এর প্রধান পার্থক্য হলো কমলার খোসা ঢিলা কিন্তু মাল্টার খোসা সংযুক্ত ( টাইট )। বিশ্বের সর্বমোট উৎপাদিত সাইট্রাস ফসলের দুই তৃতীয়াংশ হলো মাল্টা। ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চীন মাল্টার আদি উৎপত্তি স্থল। তবে বর্তমানে এই ফলটি বিশ্বের উষ্ম ও অব উষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় বেশি চাষাবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশে এই ফলটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং দিন দিন বেড়ে চলছে। কমলার তুলনায় এর অভিযোজন ক্ষমতা বেশি হওয়ায়, পাহাড়ি এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য এলাকায় সহজেই চাষ করা যাচ্ছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষক এর চাষ করে সফল হচ্ছেন। উন্নত জাত ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যবহার করে এর উৎপাদন বহুগুণে বাড়ানো সম্ভব।
জলবায়ু ও মাটিঃ কম বৃষ্টিবহুল সুনির্দিষ্ট গ্রীষ্ম ও শীতকাল অর্থাৎ শুষ্ক ও উষ্ণ জলবায়ু মাল্টা চাষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। বায়ুমণ্ডলের আর্দ্রতা ও বেশি বৃষ্টিপাত মাল্টা ফলের গুনাগুণকে প্রভাবিত করে। বাতাসে অধিক আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপ্রবণ এলাকায় মাল্টার খোসা পাতলা হয় এবং ফল বেশি রসালো ও নিম্ন মানের হয়। শুষ্ক আবহাওয়ায় ফলের মান ও স্বাদ উন্নতমানের হয়। আর্দ্র জলবায়ুতে রোগ ও ক্ষতিকর পাকার আক্রমণ বেশি হয়। মাল্টা গাছ আলো পছন্দ করে এবং ছায়ায় বৃদ্ধি ও ফলের গুণগত মান কমে যায়। সব ধরণের মাটিতে জন্মালেও সুনিষ্কাশিত, উর্বর, মধ্যম থেকে হালকা দোআঁশ মাটি মাল্টা চাষের জন্য উত্তম। মধ্যম অম্ল থেকে সামান্য ক্ষারীয় মাটিতে মাল্টা জন্মে। তবে ৫.৫ থেকে ৬.৫ (ph) অম্লতায় ভালো জন্মে। জলাবদ্ধতা মোটেও সহ্য করতে পারে না এবং উচ্চ তাপ ও লবণের প্রতি সংবেদনশীল।
জাতঃ বাংলাদেশের বাজারে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সবুজ ও কমলা রঙের মাল্টা বিক্রি করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট “বারি মাল্টা-১” নামে ২০০৩ সালে মাল্টার এই উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে, যে জাতটির পাকা ফল দেখতে সবুজ ও খেতে সুস্বাদু।
বারি মাল্টা-১ এর বৈশিষ্ট্যঃ নিয়মিত ফল দানকারী উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ খাটো, ছড়ানো ও ঝোপালো। মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্র মাস পর্যন্ত গাছে ফুল আসে এবং কার্তিক মাসে ফল আহরণের উপযোগী হয়। ফল গোলাকার ও মাঝারি (১৫০ গ্রাম) আকৃতির। পাকা ফলের রং সবুজ। ফলের পুস্প প্রান্তে পয়সা সদৃশ সামান্য নিচু বৃত্ত বিদ্যমান। ফলের খোসা মধ্যম পুরু ও শাসের সাথে সংযুক্ত। শাস হলুদ ভাব, রসালো, খেতে মিষ্টি ও সুস্বাদু। গাছ প্রতি ৩০০-৪০০ ফল ধরে। হেক্টর প্রতি ফলন ২০ টন। দেশের সব অঞ্চলে চাষের উপযোগী।
বংশবিস্তারঃ বীজ ও কলমের মাধ্যমে মাল্টার বংশবিস্তার করা যায়। তবে বীজের চারা আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ার সাথে সমন্বয় করে বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। তাই কলমের মাধ্যমেই চারা তৈরি করা উত্তম। তাছাড়া কলমের তৈরি চারায় মাতৃগুন বজায় থাকে ও দ্রুত ফল ধরে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধী ও বলিষ্ঠ শিকড় সমৃদ্ধ আদি জোড়ের মাধ্যমে কলম করলে গাছের জীবনকাল ও ফলন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
জোড় কলমঃ গ্রাফটিং এর জন্য প্রথমে রুটস্টক (আদিজোড়া) উৎপাদন করতে হবে। রুটস্টক হিসেবে বাতাবিলেবু, রাফলেমন, কাটা জামির প্রভৃতি ব্যাবহার হয়। অতপর কাঙ্ক্ষিত মাতৃ গাছ হতে সায়ন (উপজোড়) সংগ্রহ করে রুটস্টকের উপর স্থাপন করে মাল্টার গাফটিং তৈরি করা হয়। রুটস্টক হিসেবে এক থেকে দের বসর বয়সের সুস্থ্য, সবল, সোজা, বাড়ন্ত চারা নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচিত মাতৃগাছ হতে সায়ন তৈরির জন্য দুটি চোখ সহ ৫/৬ সেমি লম্বা ও ৮/৯ মাস বয়সের ডালা সংগ্রহ করতে হবে। মধ্য বৈশাখ-মধ্য ভাদ্র (মে- আগস্ট) মাস পর্যন্ত গ্রাফটিং করা যায়। ভিনিয়ার ও ক্লেফট গ্রাফটিং উভয় পদ্ধতিতে মাল্টার কলম তৈরি করা যায়। সাধারণত কলম করার ১০-১৫ দিনের মধ্যে রুটস্টক ও সায়নের মধ্যে সংযোগ স্থাপন হয় ও সায়নের চোখ ফুটে কুশি বের হয়।কলম হতে একাধিক ডাল বের হলে সুস্থ্য সবল ও সোজা ভাবে বেড়ে ওঠা ডালটি রেখে, বাকীগুলো কেটে ফেলতে হবে। আদিজোড়া থেকে বাড়ন্ত কুশি নিয়মিত কেটে দিতে হবে।
জমি নির্বাচন ও তৈরিঃ সারাদিন রোদ পড়ে ও বৃষ্টির পানি জমে না এমন উচু বা মঝারি উচু জমি মাল্টা চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। আগাছা পরিস্কার ও আশেপাশে উচু গাছ থাকলে ডালা ছেঁটে দিতে হবে।
রোপণ পদ্ধতিঃ ষড়ভুজ বা বর্গাকার পদ্ধতিতে চারা বা কলম রোপণ করতে হবে। মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য ভাদ্র ( মে- আগস্ট) মাস রোপণের উত্তম সময়। তবে পানি বা সেচের ব্যাবস্থা থাকলে সারা বসর রোপণ করা যায়।
মাদা তৈরিঃ চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে উভয় দিকে ৩/৪ মিটার দূরত্বে ৭৫x৭৫x৭৫ সেমি মাপে গর্ত খুড়তে হবে। প্রতি গর্তে ১৫ কেজি পচা গোবর, ৪/৫ কেজি ছাই, ২৫০গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ৫ গ্রাম বরিক এসিড, ৫০০ গ্রাম চুন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্তে ভরে দিতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০-১৫ দিন পরে চারা রোপণ করতে হবে।
চারা/ কলম রোপণঃ গর্তে সার প্রয়োগের ১০-১৫ দিন পরে চারা/ কলম গর্তের মাঝ বরাবর সোজা করে রোপণ করতে হবে। রোপণের পর খুঁটি দিয়ে বেধে দিতে হবে। প্রয়োজন মত সেচের ব্যাবস্থা করতে হবে।
পরিচর্যাঃ চারার যথাযথ বৃদ্ধির জন্য সময় মত সঠিক পরিমান ও পদ্ধতিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সারের পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে। বয়স ভেদে গাছ প্রতি সার প্রয়োগের পরিমাণ নিম্নররূপ-
গাছের বয়স (বছর) | গোবর সার (কেজি) | ইউরিয়া সার (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিংক সালফেট (গ্রাম) | বরিক এসিড (গ্রাম) |
১-২ | ১০-১২ | ২০০-৩০০ | ১০০-১৫০ | ১০০-১৫০ | ১০ | ৫ |
৩-৪ | ১২-১৫ | ৩০০-৪৫০ | ১৫০-২০০ | ১৫০-২০০ | ১৫ | ৮ |
৫-৭ | ১৫-১৮ | ৪৫০-৬০০ | ২০০-৩০০ | ২০০-২৫০ | ২০ | ১০ |
৮-১০ | ১৮-২০ | ৬০০-৭০০ | ৩০০-৪৫০ | ২৫০-৩০০ | ২৫ | ১২ |
১০ এর অধিক | ২০-২৫ | ৭৫০ | ৫০০ | ৪৫০ | ৩০ | ১৫ |
প্রতি বসর মধ্য ফাল্গুন থেকে মধ্য চৈত্র (মার্চ) এবং মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (মে) মাসে বর্ষার পূর্বে ২ বার ও বর্ষার পরে মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য আশ্বিন (সেপ্টেম্বর) মাসে ১ বার মোট তিন কিস্তিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে সেচের ব্যাবস্থা না থাকলে বর্ষার আগে ও পরে ২ কিস্তিতে সার প্রয়োগ করা ভালো।
আগাছা দমনঃ বর্ষার পরে সার প্রয়োগের পর গাছের গোঁড়া থেকে একটু দূরে বিভিন্ন লতাপাতা বা খড় দ্বারা বৃত্তাকারে মালচ করে দিলে আগাছা দমন সহ শুষ্ক মৌসুমে আর্দ্রতা সংরক্ষিত হয়।
সেচঃ ভালো ফলের জন্য শুষ্ক মৌসুমে বা খরার সময় নিয়মিত সেচ দেওয়া দরকার। বর্ষার সময় গাছের গোঁড়ায় যেন পানি না জমে, সে জন্য দ্রুত নিষ্কাশন ব্যাবস্থা করতে হবে।
ডাল-পালা ছাঁটাইঃ মাল্টা গাছের জন্য ডালা ছাঁটাই অপরিহার্য। গাছ লাগানোর পরে ফল ধরার পূর্ব পর্যন্ত ধীরে ধীরে ডালা ছেঁটে গাছকে নিদিষ্ট আকার দিতে হবে, যাতে গাছ উচু না হয়ে চারদিকে ছড়াতে পারে। কারণ পার্শ্ব ডালে ফল বেশি ধরে। কাণ্ডের এক মিটার উচ্চতার সকল ডালা ছাঁটাই করতে হবে। ডালা ছাঁটাইয়ের পরে কাঁটা অংশে বোর্দোপেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। এছাড়া পানি তেউড় বা water sucker উৎপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেটে ফেলতে হবে। মরা, শুকনা, রোগাক্রান্ত ডালা ছেঁটে ফেলতে হবে।
ফল পাতলাকরণ ও ব্যাগিং: বারি মাল্টা-১ জাতের গাছে প্রতি বছর প্রচুর ফল আসে। সমস্ত ফল রাখা হলে ফল ছোট ও নিম্ন মানের হয়। এজন্য প্রতি পুস্প মঞ্জুরিতে সুস্থ্য ও সবল দেখে দুটি ফল রেখে, বাকিগুলো ছোট (মার্বেল আকৃতি) থাকা অবস্থায় ছাঁটাই করে দিতে হবে। কলমের গাছ প্রথম বা দ্বিতীয় বসর থেকে ফল দেওয়া শুরু করে। গাছের ভালো বৃদ্ধির জন্য প্রথম ২ বছর ফল না রাখাই ভালো। ফলের আকৃতি সবুজ হওয়ায় পাখি বা পোকার আক্রমণ কম হয়। তবে পরিপক্কতার পূর্বে ব্যাগিং করলে অবাঞ্ছিত পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
ফল সংগ্রহঃ ফলের পরিপক্কতার সাথে সাথে ফলের গাড় সবুজ বর্ণ, হালকা সবুজ বর্ণে বা ফ্যাঁকাসে সবুজ হতে থাকে। বারি মাল্টা-১ সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে আহরণ করা যায়। ফল সংগ্রহের পর নষ্ট বা আঘাত প্রাপ্ত ফল আলাদা করতে হবে। ভালো মানের ফলগুলো পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে ঠাণ্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
উৎসঃ কৃষি প্রযুক্তি হাতবই
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!