বেগুনের বিভিন্ন রোগের লক্ষণসমূহ ও তার দমন ব্যবস্থাপনা
বেগুন বাংলাদেশের একটি অতিপরিচিত এবং জনপ্রিয় সবজি। বাংলাদেশের অনেক কৃষক বর্তমানে বেগুনের চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। বাংলাদেশে এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন স্থানীয় ও হাইব্রিড জাতের বেগুন চাষ করা হয়ে থাকে। যেমন- তাল বেগুন চাষ করা হয় সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজার উইনিয়নের কুমারগাও গ্রামে। তবে বেগুন চাষে বেগুন ক্ষেতে বেশ কিছু রোগ ও পোকার আক্রমণ দেখা যায়। নিম্নে বেগুন গাছের কিছু ক্ষতিকর রোগের লক্ষণ ও দমন ব্যবস্থাপনা উল্লেখ করা হলো-
রোগের প্রভাব, লক্ষণসমূহ ও দমন ব্যবস্থাপনাঃ
বেগুনের ঢলে পড়া (Wilt of Brinjal) রোগের লক্ষণ: Fusarium oxysporum নামক ছত্রাক দ্বারা এই রোগ হয়ে থাকে।
- আক্রান্ত গাছের পাতা হালকা হলুদ হয়ে যায়।
- গাছের এক প্রান্ত ঢলে পড়ে পড়ার পর ধীরে ধীরে অন্য প্রান্ত ঢলে পড়ে।
- এই রোগের আক্রমণে গাছের গোড়া ও শেকড় বিবর্ণ হয়ে পচে যায়।
- এ রোগের ফলে পাতা নেতিয়ে পড়ে ও গাছ ঢলে পড়ে যায়। আক্রমণ বেশি হলে পরবর্তীতে গাছ মরে যায়।
প্রতিকারঃ
- আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
- শস্য পর্যায় অবলম্বন করতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক দ্বারা চারা/বীজ শোধন করতে হবে।
- চাষের পূর্বে জমিতে শতক প্রতি ১-২ কেজি ডলোচুন বা পাথরের চুন ব্যবহার করতে হবে।
- রোগাক্রান্ত স্থানে ক্যালসিয়াম সাইনামাইড ( Calcium cyanamide ) প্রয়োগ করা যেতে পারে।
- এছাড়াও নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে অ্যামোনিয়ামের পরিবর্তে নাইট্রেট ব্যবহার করলে রোগের আক্রমণ কিছুটা কমে।
- আক্রান্ত গাছে কপার অক্সিক্লোরাইড ( সানভিট ) বা কপার হাইড্রোঅক্সাইড ( চাম্পিয়ান) ২ গ্রাম/লিটার পানি অথবা বর্দোমিকচার ( ১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম পাথুরে চুন ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
বেগুনের ঢলে পড়া (Wilt of Brinjal) রোগের লক্ষণঃ Ralstonia solanacearum নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
- যেকোন বয়সের গাছে এই রোগের আক্রমণ হতে পারে।
- আক্রান্ত গাছ হঠাৎ ঢলে পড়ে অর্থাৎ সকালে সুস্থ ও বিকালে ঢলে পড়ে। ২-৩ দিন পরে গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
- প্রাথমিক অবস্থায় গাছের শিকড় আক্রান্ত হয়। ফলে জীবাণু গাছকে মাটি থেকে পানি গ্রহণ ও সঞ্চালনে বাধা প্রদান করে এবং গাছ ঢলে পড়ে মারা যায়।
- মাঝে মাঝে আক্রান্ত গাছের নিচের পাতার শিরা ঝলসে যেতে দেখা যায়।
- আক্রান্ত ডাল/কাণ্ড কেটে পরিষ্কার পানিতে রাখলে সাদা সুতার মতো মাইসেলিয়াম ডুবানো প্রান্ত থেকে বের হয়।
প্রতিকারঃ
- আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে সোলানেসি পরিবারের ( বেগুন, টমেটো, আলু, মরিচ ইত্যাদি) ২-৩ বছর চাষ না করা।
- জমি তৈরির সময় দানাদার কীটনাশক ( ফুরাডান/কার্বোফুরান) ৩ কেজি/একর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- চারা রোপণের ২০-২৫ দিন আগে ব্লিচিং পাউডার ২.৬ কেজি/বিঘা শেষ চাষে ব্যবহার করতে হবে।
- আক্রান্ত গাছে কপার অক্সিক্লোরাইড ( সানভিট/কুপ্রাভিট ) ৪ গ্রাম/লিটার পানি অথবা বর্দোমিকচার ( ১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম পাথুরে চুন ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
- ৭-১০ লিটার পানিতে ১ গ্রাম স্ট্রেপ্টোমাইসিন/প্লাটোমাইসিন মিশিয়ে তাতে চারা ১৫-২০ মিনিট ডুবিতে রাখলে উপকার পাওয়া যায়।
বেগুনের ছোট পাতা (Little leaf of brinjal) রোগের লক্ষণঃ মাইকোপ্লাজমা দ্বারা বেগুনের পাতা ছোট হয়ে যাওয়া রোগ হয়ে থাকে।
- জ্যাসিড পোকা এই মাইকোপ্লাজমা রোগ ছড়ায়।
- বেগুনের ঋতুতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে জ্যাসিড পোকার আক্রমণ বাড়ে।
- সাধারণত ১ মাস বয়সের গাছে এ রোগ দেখা দিলেও পূর্ণ বয়স্ক গাছে এ রোগের আক্রমণ বাড়ে।
- আক্রান্ত গাছে ছোট ছোট অনেক পাতা দেখা যায় এবং পাতাগুলো গুচ্ছ আকারে দেখা যায়।
- আক্রান্ত গাছে বেগুন হয় না। আর গাছে ২-১ টি বেগুন ধরলেও গুনগত মানসম্পন্ন হয় না।
প্রতিকারঃ
- রোগাক্রান্ত গাছ তুলে ধ্বংস করতে হবে।
- আক্রান্ত জমিতে সোলানেসি পরিবারভুক্ত ফসলের চাষ কমাতে হবে।
- আক্রান্ত গাছের গোড়ায় গাছ প্রতি ২৫ গ্রাম চুন মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে গাছ ক্রমেই সুস্থ হয়ে যায়।
- আক্রমণের হার বেশি হলে ইমিডাক্লোরপ্রিড (এডমায়ার/টিডো/ইমিটাফ) ১মিলি/লিটার অথবা এসিফেট ( এসিটাফ) ০.২৫মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
বেগুনের ফল ও কাণ্ড পচা (Fruit and stem Rot of Brinjal) রোগের লক্ষণঃ Phomopsis vexans নামক ছত্রাক দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
- বীজ, চারা, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফলে এ রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।
- আক্রান্ত গাছের ডালে বা কাণ্ডে ক্যাংকার দেখা যায়।
- ডাল চক্রাকারে পচে গাছ মারা যায়।
- পাতার উপরে ধূসর/ বাদামি বলয়ে ঘেরা ও কেন্দ্রস্থলে হলুদ বর্ণের দাগ পড়ে। বেশি আক্রান্ত হলে পাতা হলুদ হয়ে ধীরে ধীরে ঝড়ে পড়ে ও মারা যায়।
- ফলের উপর কিছু কিছু স্থানে ফ্যাকাশে ডাবানো গোলাকার তালির মতো দাগ পড়ে। এ দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে পুরো ফল ঘিরে ফেলে এবং ফলের রং নষ্ট হয়ে যায়।
- আক্রান্ত বীজ কালচে হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ
- প্রতিবছর সোলানেসি পরিবারভুক্ত ফসল একই জমিতে চাষ না করা।
- রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
- রোগমুক্ত জমি থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে দিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
- কার্বেন্ডাজিম (অটোস্টিন) ২ গ্রাম/লিটার পানি অথবা প্রোপিকোনাজোল (টিল্ট ২৫০ ইসি) ১ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ২-৩ বার জমির সব গুলো গাছে স্প্রে করতে হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!