ভ্যানিলা চাষের নতুন প্রযুক্তি এখন বাংলাদেশে। ভ্যানিলার ব্যবহার
ভ্যানিলা সম্প্রতি পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান মসলা হিসাবে পরিচিত। ভ্যানিলার বাণিজ্যিক উৎপাদনের দ্বার উন্মোচন করেছেন বাংলাদেশি গবেষক ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ.এফ.এম. জামাল উদ্দিন। তিনি দেশের মাটিতেই বাণিজ্যিকভাবে ভ্যানিলা চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন। সেই ২০০৪ সাল থেকে ভ্যানিলার চাষ পদ্ধতি ও সহজতর পরাগায়ন নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। এত বছরের গবেষণার পর অবশেষে সফল হলেন এই গবেষক। তাঁর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ভ্যানিলা উৎপাদন শুরু হয়েছে।
ভ্যানিলা চাষের পদ্ধতি: ভ্যানিলা মূলত অর্কিড জাতীয় গাছ। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেড় হাজার মিটার উচ্চতায় আর্দ্র জলবায়ুতে জন্মে। ছায়া পছন্দকারী এই উদ্ভিদটি যেন মাটির সংস্পর্শে না আসে, সেদিকে খেয়াল রেখে খুঁটির সঙ্গে জাল দিয়ে কোকোডাস্ট (নারিকেলের খোসা বা ছোবড়া থেকে তৈরি জৈবসার) বেঁধে অবলম্বন তৈরি করে দিতে হয়। মূলত কলম প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই উদ্ভিদটি জৈবপদার্থসমৃদ্ধ ঝরঝরে বেলে-দোআঁশ মাটিতে জন্মে। এক্ষেত্রে মাটির পিএইচ (pH) রাখতে হয় ৫.৩ থেকে ৫.৬-এর মধ্যে।
যে জায়গাটিতে ভ্যানিলা চাষ করা হচ্ছে সেখানে যেন কড়া রোদ না থাকে। সবথেকে ভালো হয় কোন ছাউনিওয়ালা ঘর তৈরি করে তারপর সেখানে ভ্যানিলা চাষ করা। ছায়াময় জায়গায় ভ্যানিলার ফলন কিন্তু বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। বড় বড় কোন গাছ চাষ করা হলে তার মাঝে ফাঁকা জায়গাগুলিতে ভ্যানিলা চাষ করা যেতে পারে। এক একর জমিতে ভ্যানিলার চারা লাগানো যেতে পারে, ২৪০০ থেকে ২৫০০ টি। ভ্যানিলা চারা রোপণের ৩-৪ বছর পরে ফুল আসতে শুরু করে। প্রতিটি থোকায় ১৫-২০টি ফুল ধরে। প্রতিটি ফুল থেকে একটি করে পড (অঙ্কুরের মতো) হয়।
ভ্যানিলা উৎপাদনে সমস্যাঃ ভ্যানিলা উৎপাদনের মূল সমস্যা এর ফুলের বৈচিত্র্যময় গঠন। এটি স্বাভাবিক পরাগায়নে বাধা দেয়। সাধারণত প্রাকৃতিক পরাগায়নে উৎপাদন খুব কম হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে কৃত্রিম পরাগায়ন করার প্রয়োজন পড়ে। ভ্যানিলা ফুলের পরাগধানী ও গর্ভমুণ্ডের মাঝে ঠোঁটসদৃশ একটি পর্দা থাকায় পরাগরেণু গর্ভমুণ্ডে গিয়ে পড়তে পারে না।
এ বিষয়ে অধ্যাপক এ.এফ.এম. জামাল উদ্দিন বলেন, পর্দাটি নিডল বা সুঁচ দিয়ে সরিয়ে সামান্য চাপ দিলেই পরাগায়ন সম্পন্ন হয়ে যায়। তবে কাজটি করতে দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন। একজন দক্ষ শ্রমিকের পক্ষে দিনে ১-১.৫ হাজার ফুল পরাগায়ন করা সম্ভব। তিনি আরও জানান, পরাগায়ন থেকে পড পরিপক্ক হতে ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগে। বছরে হেক্টর প্রতি ৩০০-৬০০ কেজি পড সংগ্রহ করতে পারবেন একজন কৃষক। পড পরিপক্ক হওয়ার শেষের দিকে এতে গ্লুকোভ্যালিন উৎপাদিত হয়। ফারমেন্টেশনের সময় এটি গ্লুকোজ ও ভ্যানিলিনে পরিণত হয়। এই ভ্যানিলিন থেকেই তৈরি হয় মোহনীয় এই নির্যাস। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে এই অর্থকারী ফসল—এমনটাই বিশ্বাস করেন গবেষক ও অধ্যাপক এ.এফ.এম.জামাল উদ্দিন।
ভ্যানিলার ব্যবহারঃ লম্বা লম্বা বিনসের মতো দেখতে এই ভ্যানিলা খাবার থেকে শুরু করে কসমেটিকস তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। এর গন্ধ খুবই সুন্দর হয়। যার কারণে কেক সহ বিভিন্ন মিষ্টি জিনিস তৈরি করতে ভ্যানিলা এসেন্স ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই নয় পারফিউম তৈরি করতেও ভ্যানিলা কাজে লাগে। এর সুগন্ধ মোহিত করবে যে কোন মানুষকে। ভ্যানিলা ফ্লেভারের কেক কিংউ ভ্যানিলা আইসক্রিমের কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। সেগুলি তৈরি করার জন্য ব্যবহার হয় এই ভ্যানিলার। বিদেশের বাজারে এর চাহিদা বিপুল। তাই ১৯৯০ সাল থেকে ভারতেও এর চাষ শুরু হয়েছে। তবে ভারতের সব জায়গায় এখনও পর্যন্ত এই চাষের প্রচলন তেমনভাবে হয়নি।
ভ্যানিলার পুষ্টিগুণ: ভ্যানিলা ফলের ভেতরে যে ছোটখাটো বীজগুলি থাকে আসল দাম সেগুলিরই। ওই বীজের মধ্যে থাকে ভ্যানিলিন নামক একটি সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান। যা আমাদের শরীরে উপস্থিত খারাপ কোলেস্টরলকে সরিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ায়। এছাড়াও ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধ করতে ভ্যানিলা ফল এবং তার বীজ অত্যন্ত উপকারী বলে বিবেচিত হয়েছে। পেট পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মত গুণ রয়েছে এই ফলে। তাই ভ্যানিলার চাষ যেকোনো কৃষকের ভাগ্য বদলাতে কিন্তু ভীষণ সহায়ক হতে পারে।
ভ্যানিলা চাষের সম্ভাবনাঃ অধ্যাপক এ.এফ.এম. জামাল উদ্দিন বলেন, এই মসলার বাণিজ্যিক উৎপাদন বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। বেকারি ও নির্যাস শিল্পের অন্যতম উপাদান ভ্যানিলা। এই মসলার কেজি প্রতি পডের দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। পরাগায়ন জটিলতার কারণে মসলাটি এতদিন দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হতো বাংলাদেশকে। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে বর্তমানে দেশেই ভ্যানিলার বাণিজ্যিক উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!