মৌমাছি চাষের ইতিহাস ও মৌমাছির প্রজাতিসমূহের তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য
প্রথম খণ্ড
মৌমাছি চাষের ইতিহাসঃ
মৌমাছি চাষের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও পদ্ধতিগতভাবে সর্বপ্রথম ১৬৩৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌমাছি চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮৪০ সালে মোসেস কুইনবি নামক বৈজ্ঞানিক মৌচাষ শুরু করেন। ১৮৫৩ সালে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু করেন ল্যাংষ্ট্রোথ নামক বৈজ্ঞানিক যাকে আধুনিক মৌচাষের জনক বলা হয়। ১৮৮৪ সালে সর্বপ্রথম ডকলাস নামক একজন ইংরেজ ভারতীয় উপমহাদেশে মৌচাষের প্রবর্তন করেন। নিউটন নামক একজন ব্রিটিশ নাগরিক ১৯১১ সালে মৌবাক্সকে বর্তমান পর্যায়ে নিয়ে আসেন।
পরবর্তীতে কুমিল্লা পল্লি উন্নয়ন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ড. আক্তার হামিদ খান ১৯৫৮ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মৌচাষের সূচনা করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে বাংলাদশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন ( বিসিক ) বাগেরহাট জেলার যাত্রাপুরে সর্বপ্রথম জনগণকে মৌমাছি পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন।
মৌমাছির প্রজাতিঃ
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রধানত ৫ প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়। যেমনঃ (১) এপিস মেলিফেরা, (২) এপিস সেরেনা, (৩) এপিস ডরসাটা, (৪) এপিস ফ্লোরিয়া এবং (৫) এপিস ট্রাইগোনা।
এপিস মেলিফেরা : ইউরোপীয় জাতের এ মৌমাছি শান্ত ধরণের হয়। রানী মৌমাছির ডিম দেওয়ার ক্ষমতা দৈনিক ১০০০-৩০০০ টি । যার ফলে কলোনিতে শ্রমিক মৌমাছি বেড়ে যায় এবং মধু উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। উৎপাদনক্ষম প্রতিটি মৌ-কলোনি থাকে বছরে গড় মধু উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ কেজি। এদের দৈহিক আকার বড় হওয়ায় বেশি পরিমাণে নেকটার ও পোলেন সংগ্রহ করতে পারে। ১৯৯৫ সাল থাকে বাংলাদেশে এই প্রজাতির চাষ শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে মৌচাষের জন্য এই প্রজাতি সবচেয়ে উপযোগী।
এপিস সেরেনা : এই প্রজাতির মৌমাছির উৎপত্তিস্থল এশিয়া মহাদেশে। এদেরকে ভারতীয় মৌমাছিও বলা হয়। এই প্রজাতি তুলনামূলক শান্ত ও সহিষ্ণু স্বভাবের। রানী মৌমাছির ডিম দেওয়ার ক্ষমতা দৈনিক ২০০-৮০০ টি । যার ফলে কলোনিতে শ্রমিক মৌমাছি কম হয় এবং মধু উৎপাদন কমে যায়। উৎপাদনক্ষম প্রতিটি মৌ-কলোনি থাকে বছরে গড় মধু উৎপাদন ক্ষমতা ১০ কেজি। এদের দৈহিক আকার ছোট হওয়ায় বেশি পরিমাণে নেকটার ও পোলেন সংগ্রহ করতে পারে না। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধু এপিস সেরেনা প্রজাতির চাষ করা হতো।
এপিস ডরসাটা : এই প্রজাতির মৌমাছির উৎপত্তিস্থল এশিয়া মহাদেশে। এই মৌমাছিকে অঞ্চলভেদে পাহাড়িয়া রাক্ষুসে, মধুমাছি, মধুবল্লা, আড়াইল্যা, দৈত্য মৌমাছি ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। এরা খোলা আলোবাতাস পূর্ণ গাছের ডাল, ঘরের কার্নিসে ঝুলন্ত একটি মাত্র চাক তৈরি করে। এরা হিংস্র স্বভাবের এবং গায়ের রং কালো ধরণের হয়। এরা ঘন ঘন জায়গা পরিবর্তন করে। হিংস্র বলে এই মৌমাছিকে এখনও বাক্সে পোষ মানানো সম্ভব হয়নি। গড়ে প্রতি বছর ৩০ কেজি মধু উৎপাদন হয়।
এপিস ফ্লোরিয়া : এরা আকারে ছোট, সোনালি রঙের এবং শান্ত প্রকৃতির। এর আদিবাস এশিয়া অঞ্চলে। এই প্রজাতির মৌমাছিকে ক্ষুদে মৌমাছি বলা হয়ে থাকে। এরা ঝোপ-ঝাড়ে ছোট ঝুলন্ত চাক তৈরি করে। এরা বাসা বাধার জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানই পছন্দ করে। এদের একটি কলোনি থাকে বছরে ৩০০-৫০০ গ্রাম মধু পাওয়া যায়।
এপিস ট্রাইগোনাঃ এই প্রজাতির মৌমাছিকে পিঁপীলিকা মৌমাছি বলা হয়ে থাকে। এরা আকারে সবচেয়ে ছোট, গায়ের রং কালো এবং হুলবিহীন। এরা গাছের ছোট ছোট গর্তে বাসা বাঁধে। এদের মধু উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। একটি কলোনি থেকে বছরে ১০০-২০০ গ্রাম মধু পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়।
এই ৫ প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে এপিস মেলিফেরা এবং এপিস সেরেনা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে উৎপাদিত মধুর ৯০% আসে এপিস মেলিফেরা প্রজাতির মৌ খামার থেকে।
মৌমাছির কলোনিঃ একটি মৌ-কলোনিতে ৩ ধরনের মৌমাছি থাকে। যথাঃ রানী মৌমাছি,পুরুষ মৌমাছি এবং কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি।
রানী মৌমাছিঃ একটি মৌ-কলোনিতে ১ টি মাত্র রানী মৌমাছি থাকে। এরা দৈনিক ২০০০ পর্যন্ত ডিম দিয়ে থাকে। উর্বর ডিম থেকে জন্মায় রানী ও শ্রমিক মৌমাছি এবং অনুর্বর ডিম থেকে জন্মায় পুরুষ মৌমাছি। প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব দেখা দিলে রানী মৌমাছি ডিম পাড়া বন্ধ করে দেয়। এরা ৩ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং ২ বছর পরে ডিম পাড়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এজন্য ২ বছর পর নতুন রানী তৈরি করে পুরাতন রানীকে চাক থাকে বের করে দিতে হবে।
পুরুষ মৌমাছিঃ একটি মৌ-কলোনিতে ১-৩০০ টি পর্যন্ত পুরুষ মৌমাছি থাকে। এরা আকারে শ্রমিক মৌমাছির চেয়ে বড় কিন্তু রানী মোমাছির থেকে ছোট। এদের প্রধান কাজ রানী মৌমাছির সাথে জৈবিক মিলন ঘটিয়ে রানীর গর্ভধারণ করানো। তবে একবার জৈবিক মিলনের পর পুরুষ মৌমাছি মারা যায়। এছাড়াও এদের আরেকটি কাজ হলো রানী কতৃক ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে মৌচাকে যে তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় তা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
শ্রমিক মৌমাছিঃ একটি মৌ-কলোনিতে ৫০,০০০ পর্যন্ত শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছি থাকে। কলোনির যাবতীয় কাজ এরা করে থাকে। এরা আকারে শ্রমিক ও রানী মোমাছির থেকে ছোট। এদের ২ টি পাকস্থলী থাকে। ১ টিতে খাদ্য হজম করে এবং অন্যটিতে ফুল থেকে পুষ্পরস ও পোলেন ( পরাগরেনু ) সংগ্রহ করে মৌচাকে এনে জমা করে রাখে। শ্রমিক মৌমাছিদের মোমগ্রন্থী থাকে। আর এই মোমগ্রন্থী থাকেই মোমের উৎপত্তি হয়ে থাকে যা দ্বারা তারা মৌচাক তৈরি করে থাকে।
মৌমাছির জীবনচক্রঃ এপিস মেলিফেরা ও এপিস সেরেনা প্রজাতির মৌমাছির জীবনচক্রে ৪ টি ধাপ দেখা যায়। যথাঃ ডিম ( Egg ), শূককীট ( Larva ),মুককীট ( Pupa ) এবং পূর্ণাঙ্গ মৌমাছি (Imago )। নিম্নে ছকাকারে দেখানো হলো-
ধাপসমূহ | রানী | পুরুষ | শ্রমিক |
ডিম | ৩ দিন | ৩ দিন | ৩ দিন |
শূককীট | ৫ দিন | সাড়ে ৬ দিন | ৬ দিন |
মুককীট | ৮ দিন | সাড়ে ১৪ দিন | ১২ দিন |
পূর্ণাঙ্গ মৌমাছি | ১৬ দিন | ২৪ দিন | ২১ দিন |
আয়ুষ্কাল | ২-৩ বছর | ৩-১২ মাস | ৩-৬ মাস |
মৌমাছির খাবারঃ
- রানী মৌমাছির প্রধান খাদ্য হলো রয়েল জেলি বা রাজভোগ। ৭-১১ দিন বয়সের শ্রমিক মৌমাছির ফেরেনজিয়াল গ্রন্থি থেকে এ জেলি নিঃসৃত হয়ে থাকে। রানী মৌমাছি পানি পান করে এবং প্রয়োজনে মধু ও মৌ-রুটিও খায়।
- পুরুষ মৌমাছির খাবার হলো মৌ-চাকে সঞ্চিত মধু।
- শ্রমিক মৌমাছির খাদ্য মূলত পুষ্পরস বা নেক্টার ও বি-ব্রেড। প্রকৃতিতে খাদ্যাভাব দেখা দিলেএরা চাকে জমানো মধু খেয়ে থাকে। চাকের মধুর পরিমাণ কমে গেলে প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যাদি খেয়ে থাকে এবং পানিও খায়।
- বাচ্চা মৌমাছি মূলত পুষ্পরস ও পরাগরেণুর সংমিশ্রনে তৈরি মৌ-রুটি বা বি-ব্রেড খেয়ে থাকে। এদেরকে সামান্য পরিমাণে রয়েল জেলিও সরবরাহ করা হয়।
প্রকৃতি থেকে শ্রমিক মৌমাছি মূলত ২ ধরনের খাদ্য সংগ্রহ করে থাকে। যথাঃ পুষ্পরস বা নেক্টার এবং পরাগরেণু বা পোলেন।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!