কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রানী মৌমাছি উৎপাদন| মৌচাষে ডিএইর ভূমিকা
২য় খণ্ড
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রানী মৌমাছি উৎপাদনঃ মৌমাছির কৃত্রিম প্রজনন মূলত ভালো জাতের শুক্র সংগ্রহ করে তা রানী মৌমাছির জননেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করানো ( Artificial Insemination )। এতে রানী মৌমাছি যৌন মিলন ছাড়াই নিষিক্ত ডিম প্রসব করতে পারে। এই পদ্ধতিই হলো কৃত্রিম প্রজনন। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশই এখন মৌমাছির প্রজননে কৃত্রিম কলাকৌশল অবলম্বন করে রানী মৌমাছি উৎপন্ন করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রানী মৌমাছি উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রথম শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে রানী মৌমাছি উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কৃত্রিম প্রজননের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী রানী উৎপাদন এবং এ রানীর মাধ্যমে উন্নত বৈশিষ্ট্যাবলির বংশায়ন। এজন্য যেমন প্রয়োজন উন্নত বৈশিষ্ট্যের রানী মৌমাছি ঠিক তেমনি প্রয়োজন ভালো জাতের শুক্র।
বর্তমানে কৃত্রিম সঙ্গমের ( Artificial Insemination ) এর জন্য বিভিন্ন ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে Schley Insemination Instrument। জার্মানির একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক Dr. Peter Schley এই যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন। এই যন্ত্রের সাহায্যে ১ টি রানী মৌমাছিকে সঙ্গম করাতে সময় লাগে মাত্র ২ মিনিট।
মৌচাষে ডিএই ( DAE ) এর ভূমিকাঃ বর্তমানে কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ ( ৩য় পর্যায় ) প্রকল্পের মাধ্যমে মৌচাষ সম্প্রসারণে বিসিকের সাথে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ডিএই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক জনাব মোঃ খায়রুল আলম প্রিন্স এর তত্ত্বাবধানে ৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটি জুলাই/২০১৭ হতে জুন/২০২২ খ্রিঃ পর্যন্ত মৌচাষ সম্প্রসারণে কাজ করে যাবে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০০ ব্যাচ ( প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে ) কৃষক/ বীজ এসএমই ( SME ) ৩ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রতি বছর ৪০ মে. টন করে প্রকল্পাধীন সময়ে প্রায় ১৬০ মে. টন মধু উৎপাদিত হবে। ফসলে পরাগায়ন কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য বীজ এসএমই ( SME ) কে প্রকল্প থেকে মৌবাক্স সরবরাহ করা হচ্ছে। অফিসার প্রশিক্ষণ ( টিওটি ) প্রদান করা হচ্ছে প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে ৩০ ব্যাচে সর্বমোট ৯০০ জন অফিসারকে। মৌচাষের উপর ২ ব্যাচে ৩০ জন করে মোট ৬০ জন কর্মকর্তাকে সার্টিফিকেট কোর্স করানো হচ্ছে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ প্রকল্পে ৫ ব্যাচে ১০০ জন কর্মকর্তার বৈদেশিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফসল উৎপাদন ও বীজ ব্যবস্থাপনা, মৌচাষ ও এসএমই ( SME ) ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির উপর ব্লক পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতি ব্যাচে ৩০ জন করে ১৫০ ব্যাচে মোট ৪৫০০ জন এসএএও ( SAAO ) কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়াও কৃষক ও এসএমই ( SME ) পুরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে।
এছাড়া যেসব এলাকায় মৌচাষের সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে এসএমইদেরকে ( SME ) মৌ-বাক্স, মধু এক্সট্রাক্টর এবং এক্সেসরিজ সরবরাহ করা হচ্ছে। যার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মধু উৎপাদন ও গ্রামীন কর্মসংস্থান তৈরিসহ ফসলের উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। এই প্রকল্পে মৌচাষ সম্পৃক্ত হওয়ায় ফসলের অতিরিক্ত ১৫-৩০% ফলন বৃদ্ধিসহ মধু উৎপাদন ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে কৃষক আগ্রহী হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
পরাগায়নে মৌমাছির ভূমিকাঃ পর-পরাগায়ন বা স্ব-পরাগায়নের জন্য এক ফুল থেকে অন্য ফুলে পরাগরেণু স্থানান্তর হওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে কীট পতঙ্গের মাধ্যমে এ ধরনের পরাগায়ন হয়ে থাকে। তবে সমগ্র কীট পতঙ্গের মধ্যে মৌমাছি দ্বারা সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭০% পরাগায়ন হয়ে থাকে।
মৌচাষ এলাকায় পর-পরাগায়নের মাধ্যমে সরিষার ফলন ৩০% বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোনো এলাকায় মৌচাষ না করে সরিষা আবাদ করলে সেখানে একরে ১০ মণ সরিষা উৎপাদিত হয়। অথচ সেই একই এলাকায় যদি মৌচাষ করা হয় তবে সেখানে সরিষার ফলন হবে একরে ১৩ মণেরও বেশি।
মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলাফলঃ একই জাতীয় ফুলে মৌমাছির পুনঃ পুনঃ আনাগোনার জন্য একই প্রকার ফুলের গর্ভমুণ্ডে পরাগরেণু পতিত হয়ে পরাগায়নের সফলতা আসে এবং গর্ভাধান বা নিষেক নিশ্চিত করে। যার ফলে নিম্নোক্ত ফলাফল পাওয়া যায়-
- ফুল থেকে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। অসফল পরাগায়ন বা ঝরে যাওয়া ফুলের পরিমাণ কমে যায়।
- ফলের আকার বড় হয় এবংমান ভালো হয়।
- অঙ্কুরোদ্গম ক্ষমতাসম্পন্ন বীজের পরিমাণ বেশি থাকে। পুষ্ট বীজের জীবনীশক্তিও বেড়ে যায়।
- বীজের আকার বড় হওয়ায় বীজ ওজনে বেশি হয়।
- বীজে তেলের পরিমাণ, প্রোটিন ও অন্যান্য উপাদান বেশি থাকে।
মৌমাছির পছন্দনীয় ফসল ও গাছপালাঃ মৌমাছি সেসব উদ্ভিদে বা গাছপালায় বিচরণ করতে পছন্দ করে তা নিম্নরূপ-
শস্য জাতীয়ঃ সরিষা, তিল, ছোলা, ধনে পাতা, মিষ্টি আলু, মউরি, ভুট্টা, তুলা, কালজিরা, ধান, অড়হর, চিনাবাদাম ইত্যাদি।
ফল জাতীয়ঃ লিচু, আম, জাম, নারিকেল, আমড়া, তেঁতুল, জলপাই, লেবু, পেয়ারা, খেজুর, কুল, আমলকি, চালতা, কলা, জামরুল, আতাফল, লটকন, কমলা, পেঁপে, সুপারি, বেল ইত্যাদি।
সবজি জাতীয়ঃ সীম, লাউ, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, বেগুন, টমেটো, মরিচ, ঢেঁড়স, পেঁয়াজ, রসুন, মুলা, বরবটি, সাজনা, চিচিংগা, পটল, শশা, ঝিঙে ইত্যাদি।
ফুল জাতীয়ঃ সূর্যমুখী, বকুল, গোলাপ, শাপলা, ডালিয়া, গাঁদা, বেলি, চাঁপা, জিনিয়া, হাস্নাহেনা, চন্দ্রমল্লিকা, মুহুয়া, রঙ্গন, শেফালি, রজনীগন্ধা ইত্যাদি।
অন্যান্য গাছঃ শিমুল, শিশু, পলাশ,হিজল, ছাতিম, গাব, মেগেদি, বাবলা, খয়ের, মেহগনি, জারুল, শাল, কড়ই, কদম, নিম, হরিতকী ইত্যাদি।
উল্লিখিত গাছপালা ছাড়াও আরও অনেক ধরনের গাছ ও আগাছা থেকে মৌমাছিরা পুষ্পরস ও পরাগরেণু সংগ্রহ করে থাকে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!