ঘেরে চিংড়ি চাষ।ঘেরে চিংড়ি চাষের ফলে সৃষ্ট সমস্যাসমুহ
চিংড়ি চাষের উপযোগী এলাকাঃ
ঘেরে চিংড়ি চাষ উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট) জন্য প্রসিদ্ধ। এর অন্যতম প্রধান দুটি কারণ হলো এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে স্বাদু ও লোনা পানি রয়েছে। অন্য কারণ হলো এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থাকা সুন্দরবন। সুন্দরবন চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের খাদ্যের প্রধান জোগানদার। সুন্দরবনের নদী-খালগুলো প্রাকৃতিকভাবে চিংড়ির পোনা উৎপাদনের এক চমৎকার জায়গা। উপকূলীয় অঞ্চলে মূলত ‘ঘের’ তৈরি করে চিংড়ি চাষ করা হয়। ঘের হলো একটি আবদ্ধ ক্ষেত্র যা জমিতে নালা কেটে বা গর্ত তৈরি করে সেই নালা বা গর্তের মাটি চারপাশে উঁচু আইলের মতো বেঁধে জলাশয় তৈরি করা হয়। চিংড়ি চাষের জন্য ঘেরগুলোর সঙ্গে সাধারণত নদীর স্রোত যোগাযোগ থাকে। জোয়ারের লোনা পানি ঘেরে ঢুকতে পারে। কাঠের স্লুইচ গেট বা বাক্স অথবা অনুচ্চ মাটির আইল জোয়ারের পানির প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। জোয়ারের পানির সঙ্গে চিংড়ির পোনাও ঘেরে প্রবেশ করে। অন্যন্য মাছের পোনাও সেই সঙ্গে ঘেরে ঢোকে। তারপরও কৃত্রিমভাবে চিংড়ি পোনা ঘেরে ছাড়া বা মজুদ করা হয়। সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ঘেরে লোনা পানি প্রবেশ করানো হয়। লোনা পানি প্রবেশের পর তা আটকে রেখে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ ধীরে ধীরে বড় করে তোলা হয়।
উপকূলে প্রায় ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর চাষাবাদের উপযোগী জমি রয়েছে। ১৯৯৪-৯৫ সনে যেখানে মাত্র ২০ হাজার হেক্টর জমি চিংড়ি চাষের অধীনে ছিল, সেখানে ১৯৯৬-৯৭ সনে বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৫ হাজার হেক্টরে এবং চিংড়ির উৎপাদন ৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টনে। বর্তমানে চিংড়ি চাষের অধীনে প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে (২০১২-১৩)।
ঘেরে চিংড়ি চাষের ফলে সৃষ্ট সমস্যাসমুহঃ
দ্রুত চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ পরিবেশ, ভূমি, কৃষি ও সে অঞ্চলের মানুষের ওপর এক স্থায়ী সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সনাতন কৃষির ধরন পাল্টে যায়। কৃষি শ্রমিকরা কাজ হারায়। গ্রামের ছেলে মেয়েরা খেলার মাঠ হারায়। পনির অবাধ প্রবাহ নষ্ট হয়। ধীরে ধীরে লবণাক্ততা গ্রাস করে ফেলে গোটা অঞ্চল জুড়ে। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় ঘুরে এসব চিত্রই পাওয়া যায়। রামপালে ১৯৭৫ সনের আগে বিস্তীর্ণ জমি জুড়ে ফলতো ধান ও অন্যান্য ফসল। তখন রামপালের প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতেই ফসল চাষ করা হতো। অথচ ১৯৯৯ সনেই সেখানে চিংড়ি চাষের ফলে ফসলের জমি কমে ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এরপর চিংড়ি চাষের চাপে জমি সংকুচিত হয়ে ফসল চাষের জমি আরও অনেক কমে গেছে। অধিকাংশ ফসলের জমিই এখন ধান-চিংড়ি চাষ বিন্যাসের কাছে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে এসব জমিতে ধান হয় ও শুষ্ক মৌসুমে হয় চিংড়ি চাষ। সত্তরের দশকের আগে সেখানে কোনো চিংড়ি ঘের ছিলনা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সনের মধ্যে পারিবারিকভাবে ও বিচ্ছিন্ন আকারে ঘের করা হতো যার আয়তন ছিল ০.২ থেকে হেক্টরের মধ্যে। পরের দেড় দশকে ঘেরের গড় আয়তন দাঁড়ায় ৬.৭৫ হেক্টর। অর্থাৎ ছোট চাষিরা আর এখন চিংড়ি চাষ করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে তাদের জমি বড় ঘেরের সঙ্গে বিলিয়ে হাড়ি বা বর্গার সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। তারা চাইলেও আর আগের মতো তাদের জমিতে ফসল চাষে ফিরে যেতে পারবে না। তাদের তা করতেও দেয়া হবে না। এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষীদের কাছে তারা জিম্মি হয়ে আছে। এমনকি বড় ও প্রভাবশালী চিংড়ি চাষিরা তাদেও জমি এই মুহূর্তে ফিরিয়ে দিলেও সেসব জমিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ও উর্বরতা নষ্ট হওয়ায় সেখানে তারা আর আগের মতো ধান, পাট, গম, আলু চাষ করতে পারবে না। সেসব জমির হারানো উর্বরতা ফিরিয়ে আনা মোটেই সহজ কোনো ব্যাপার নয়। এ কথা সত্য যে, চিংড়ির সাথে অনেকে কিছু ধান চাষও করছেন। তবে সেখানে আধুনিক উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ হচ্ছে না বরং হচ্ছে নিম্নফলা স্থানীয় জাতের ধান। এতে সে অঞ্চলের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। একাধিক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এ সম্পর্কিত প্রায় প্রতিটি গবেষণায় দেখা গেছে, চিংড়ি চাষের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে এসব অঞ্চলে চাষের জমি প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গেছে। বিশেষ করে ১৯৮৫ সনের পর থেকে এ অবস্থা ব্যাপকতা পেয়েছে। আরো দেখা গেছে, একই জমিতে উপর্যুপরি চিংড়ি চাষের ফলে সেসব জমিতে লবণ সঞ্চয়ন বেড়ে গেছে। দীর্ঘস্থায়ী চিংড়ি চাষের ফলে ৫, ১০ ও ১৫ বছর পর সেসব জমির মাটির লবণাক্ততা পরীক্ষা করে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধিও পাশাপাশি সেসব জমির অম্লতা বেড়েছে এবং মাটিতে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জৈব পদার্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ভালো ফসল উৎপাদনের জন্য যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এসব বিষয় উপকূলীয় কৃষিতে বিশেষ করে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ধান চাষ কমে যাওয়ার অর্থ হলো মানুষের প্রধান খাদ্যের প্রাপ্যতা কমে যাওয়া। ধান কম হওয়া মানে গ্রামে গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য খড়ের উৎপাদন কমে যাওয়া। এর অর্থ গোসম্পদ কমে যাওয়া। বিস্তীর্ণ জমি জলমগ্ন থাকায় সেখানে সবজি ও ফল চাষ করা সম্ভব হয় না। প্রাকৃতিকভাবে ঘাসও গজায় না। এতে পশুরচারণ ভূমি নষ্ট হচ্ছে। স্বল্প কিছু সবজিও ফলের আবাদ ঘেরের পাড়ে সম্ভব হলেও তা সেসব অঞ্চলের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। জলজ পরিবেশে অনেক জীবেরই টিকে থাকা কঠিন। কাজেই সেসব অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্যও এখন হুমকির মুখে। বৃক্ষ নেই তো রান্নার জ্বালানি নেই, বৃক্ষ নেই তো ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়া। বিস্তীর্ণ এলাকা বছরের অনেকটা সময় জলমগ্ন থাকলে সেখানে বৃক্ষ আসবে কোথা থেকে? তাই সামগ্রিক বিবেচনায় এখন চিংড়ি চাষ নিয়ে আরও গবেষণা করতে হবে, খতিয়ে দেখতে হবে পরিবেশ বিপর্যয়ে ও কৃষির স্থায়ী ক্ষতির জন্য তা কতটা হুমকির? যদি ভবিষ্যতে চিংড়ির জমিতে আদৌ ফসল চাষ করা সম্ভব না হয় বা মাটির উর্বরতাকে ফিরিয়ে আনা না যায় তাহলে দরকার নেই সেই চিংড়ি চাষের। বরং বিকল্প পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে সেসব রফতানি করে আমরা চিংড়ির চেয়েও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আনতে পারি। কৃষি ও পরিবেশের ক্ষতি যে কোনো দেশের জন্য এক বড় ক্ষতি। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায় না।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!