তেলাপিয়া ও দেশি মাগুরের মিশ্র চাষ |তেলাপিয়ার সঙ্গে দেশি মাগুর চাষের সুবিধা
মিশ্র চাষ (তেলাপিয়া ও দেশি মাগুর )ঃ
দেশি মাগুর বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। দেশি মাগুরের পুষ্টিমান, স্বাদ ও বাজার মূল্য সবটাই বেশি। দেশি মাগুরকে জিওল মাছ বলে কেননা এ মাছকে দীর্ঘক্ষণ জীবিত বাজারজাত এবং পরিবহন করা যায়। বর্তমানে প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিশেষ করে খাল-বিলে দেশি মাগুর আগের মতো প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে না, তবে এ মাছটির চাষ করা সম্ভব। দেশি মাগুরের একক ও মিশ্র চাষ সম্ভব হলেও মিশ্র চাষে ভালো উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের দেশে আগে বিদেশি বা ‘আফ্রিকান মাগুর’ মাছের চাষ শুরু হওয়ার পর সাধারণ ভোক্তাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এ কারণে মাগুর চাষের প্রতি অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তবে এখন দেশি মাগুর চাষ করে ভোক্তাদের আস্থা ফিরয়ে আনা সম্ভব।
তেলাপিয়ার সঙ্গে দেশি মাগুর চাষের সুবিধাঃ
মনোসেক্স তেলাপিয়ার সঙ্গে দেশি মাগুর চাষে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যেমন-
উভয় মাছই অন্যান্য মাছের চেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে অধিক সহনশীল। পানির অক্সিজেন হ্রাস-বৃদ্ধিতে খুব ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখায় না। সম্পূরক খাবারে সহজেই অভ্যস্ত। পোনা সহজেই পাওয়া যায়। খাদ্যের জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে চাষির দুশ্চিন্তা কম।
পুকুর প্রস্তুতি :
মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিকভাবে পুকুর প্রস্তুত করা গেলে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। পুরনো পুকুর হলে পানি শুকিয়ে পাড় মেরামত এবং পুকুরে পাইপের সংযোগ থাকলে তা মেরামত করতে হবে। কোনোভাবেই পাড়ে ইঁদুরের গর্ত বা সুড়ঙ্গ থাকা যাবে না। পুকুরের তলদেশ সমান হওয়া আবশ্যক। বেশি কাদাযুক্ত পুকুর হলে তলদেশ শুকিয়ে ৩-৪ ইঞ্চি মাটি তুলে নিলে পুকুরের স্বাস্থ্য ভালো হয়। পুকুর নতুন করে খনন করা হলে তা আয়তাকার এবং ১ মিটার গভীর হতে হবে। পুকুরের ভেতরের দিকে বকচর থাকবে। তবে নতুন কাটানো পুকুরে প্রথম বছর মাগুর মাছের বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম হয়।
তেলাপিয়ার পোনা নার্সিং ও মজুদ পদ্ধতিঃ
তেলাপিয়ার মনোসেক্স পোনা হ্যাচারি থেকে নেওয়ার সময় ওজন থাকে ০.১৫-০.২ গ্রাম। এত ছোট পোনা সরাসরি চাষের পুকুরে মজুদ না করাই ভালো কারণ এতে পোনা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বাশি থাকে। এ কারণে পূর্ণ নিরাপত্তাসহ ২০-২৫ দিন তেলাপিয়ার পোনা নার্সিং করার পর গণনা করে মজুদ পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে। পুকুরে প্রতি শতাংশে ১৮০-২০০টি নার্সিং করা তেলাপিয়ার পোনা মজুদ করা যায়। তেলাপিয়ার পোনা আরো কম মজুদ করলে বিক্রির সময় তেলাপিয়ার ওজন তুলনামূলকভাবে বেশি হবে। তেলাপিয়ার পোনা মজুদ করার আগে অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত পুকুর প্রস্তুত করা আবশ্যক।
মাগুরের পোনা নার্সিং ও মজুদঃ
তেলাপিয়ার মতো মাগুরেরও ছোট পোনা সরাসরি চাষের জন্য পুকুরে দেওয়া নিরাপদ নয়। ভালো ও মানসম্মত দেশি মাগুরের পোনা সঠিক নিয়মে নার্সিং করা আবশ্যক। এ সময় মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে। মাগুরের পোনা নার্সিং করার সময় শতাংশে ১০০০ পোনা দেওয়া যায়, তবে পানির গুণাগুণ রক্ষা করা ঝুঁকিপূর্ণ হলে আরো কম পোনা নার্সিং এ দিতে হবে। কমপক্ষে ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা হওয়া পর্যন্ত নার্সিং করা উত্তম। পোনা নার্সিং করার সময় নাইলনের জালের বেষ্টনী দেওয়া আবশ্যক। তেলাপিয়ার পোনা মজুদ পুকুরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে দেশি মাগুরের তিন-চার ইঞ্চি আকারের রোগমুক্ত স্বাস্থ্যবান পোনা প্রতি শতাংশে ১০-১২টি হারে মজুদ করতে হবে। মাগুরের পোনা মজুদের সময় লক্ষ রাখতে হবে সব পোনা যেন একই মানের ও আকারের হয়।
মাছের খাবার ব্যবস্থাপনা : তেলাপিয়া এবং দেশি মাগুরের মিশ্র চাষে মানসম্মত সুষম এবং পরিমিত খাবার সরবরাহ অত্যাবশ্যক। তেলাপিয়ার খাদ্যনালি ছোট হওয়ায় একই সময়ে বেশি খাবার গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে দিনে ২-৩ বার খাবার সরবরাহ করা আবশ্যক। তেলাপিয়া এবং মাগুর মাছের মিশ্র চাষে সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তেলাপিয়াকে প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করা হলে মাগুর মাছের জন্য অধিক বা আলাদা খাবার সরবরাহ করার প্রয়োজন নেই। তেলাপিয়ার জন্য সরবরাহকৃত খাবারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে মাগুর মাছ বৃদ্ধি পায়। তেলাপিয়ার জন্য শুরুতে ২০% (দেহ ওজনের শতকরা) খাবার সরবরাহ করা হলেও পরে তা ৩%-এ নেমে আসে। তেলাপিয়ার খাবারে কমপক্ষে ২৬-২৮% প্রোটিন এবং ভিটামিন, খনিজ, এনজাইম সংযোজন করা হলে উৎপাদন ভালো হয়।
মাছ চাষে অন্যান্য পরিচর্যাঃ
পানির পিএইচ (PH) কমে গেলে চুন প্রয়োগ করা জরুরী । পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাসের নিরাপদ মাত্রা রক্ষা করতে নিয়মিত জিওলাইট এবং গ্যাসের মাত্রা বেশি হলে ‘গ্যাসোনেক্স প্লাস’ ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়ও। মাছ চাষের পুকুরে প্রতি মাসে একবার ‘গ্যাসোনেক্স প্লাস’ ব্যবহার করা ভালো। ১০-১৫ দিন পর পর তেলাপিয়ার গড় ওজন এবং স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক। সেমপ্লিং( Sampling) করার সময় মাগুর মাছ ঠিকভাবে জালে না এলে বেড়জাল টানলে মাগুর ধরা পড়ে। মাছের বৃদ্ধি, গায়ের রং, ত্বকে কোনো অস্বাভাবিক দাগ বা ক্ষত আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ২-৩ দিন খাবারের সঙ্গে এজাইম (বায়োজাইম) প্রয়োগ করা ভালো। পুকুরে খাবার এমনভাবে দিতে হবে, যাতে খাবারের অপচয় না হয়, বা চাহিদার চেয়ে কম সরবরাহ করা না হয়। মাগুর মাছের দেহ স্বাভাবিক না থাকলে ভালো বাজার মূল্য পাওয়া যায় না। যার ফলে পুকুরে ‘প্রোবায়োটিক্স’ (অ্যাকোয়া ম্যাজিক) ব্যবহার করলে পুকুরের তলদেশের পরিবেশ এবং মাছের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। মাগুর মাছের ত্বকে দাগ (সাদা তুলার মতো) দেখা দিলে মাছকে ম্যালাকাইট গ্রিন বা ফরমালিনে গোসল করালে উপশম হয়। মাছে ক্ষত রোগ দেখা দিলে শতক প্রতি ৩ ফুট পানির জন্য ১ কেজি হারে লবণ প্রয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতি একরে ৫০০ মিলি Sanitizer হিসেবে ‘পলগার্ড প্লাস’ ব্যবহারে সুফল পাওয়া যায়। অনেকে মাগুর মাছের ‘মিক্সো ব্যাকটেরিয়া’ নিয়ন্ত্রণে ‘ফুরাজলিডন’ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন যা মৎস্য খাদ্যে অনুমোদিত নয়।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!