ক্ষতিকর পোকা দমনে আলোকফাঁদ।ফাঁদ তৈরির পদ্ধতি ও ফাঁদের সীমাবদ্ধতা
ফসলের ক্ষতিকর পোকা দমনে প্রধানত বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা বা আইপিএম একটি আধুনিক ধারণা। এ পদ্ধতিতে কীটনাশক ছাড়া অন্যান্য অনেক পদ্ধতিতে ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিশেষ করে আলোকফাঁদ ও ক্ষেতে ডাল পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে অনেক পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
আলোকফাঁদ :
আলোকফাঁদ হলো কোনো কিছু আটকানোর একটা যন্ত্র। আলোকফাঁদ প্রকৃত অর্থে ফসলে পোকার উপস্থিতি যাচাই বা মনিটরিংয়ের একটি যন্ত্রবিশেষ। এই যন্ত্রে নানা রকমের কৌশল অবলম্বন করে শিকার ধরা বা আটকানোর ব্যবস্থা করা হয়। বেশ কিছু পোকা আছে যারা আলোতে আকৃষ্ট হয়। তাই আলোক ব্যবহার করে আলো-আকর্ষী এসব পোকা আটকানোর বা আকৃষ্ট করে মেরে ফেলার জন্য যে ফাঁদ তৈরি করা হয় তাকেই আলোকফাঁদ বলে।
আলোকফাঁদের উপকারিতা :
আলোকফাঁদ মূলত একটি মনিটরিং যন্ত্র, যা দিয়ে ক্ষেতে কী কী পোকা আছে তা দেখা যায়। আলোকফাঁদ দ্বারা অনেক ধরনের পোকামাকড়ের উপস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে জরিপ করা যায়। বিশেষত ফসলের যেসব পোকা আলোতে আকৃষ্ট হয় তা ক্ষেতের কাছে আলোকফাঁদ পাতলে তাতে আকৃষ্ট হয় এবং মারা পড়ে। অনেক নিশাচর প্রকৃতির পোকাও আলোকফাঁদে ধরা পড়ে। তবে আলোর গুণাগুণের ওপর ফাঁদের কার্যকারিতা নির্ভর করে। ফ্লোরোসেন্ট বা তীব্র আলোর ফাঁদে বেশি পোকা আসে। এ ছাড়া হ্যাজাক বাতি এবং ২০০ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে ভালোভাবে পোকা দমন করা যায়। তবে কেরোসিন বাতি বা হারিকেনের আলোয় পোকা আসে সবচেয়ে কম। এমনকি টায়ার পুড়িয়ে বা মশাল জ্বেলেও অনেক পোকা দমন করা যায়, যেমন ধানের গান্ধী পোকা। এসব ফাঁদ তৈরি ও ব্যবহার অত্যন্ত সহজ হওয়ায় দিনে দিনে তা কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তা ছাড়া পোকা নিয়ন্ত্রণে অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতি সস্তা ও পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে কৃষি বিভাগের পরামর্শে আমন ধানের ক্ষেতে ব্যাপকভাবে সারা দেশে আলোকফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে।
আলোকফাঁদ দিয়ে যেসব পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায় :
ফসলের শত্রু ও মিত্র সব ধরনের পোকাই আলোতে আকৃষ্ট হয়। বন্ধু পোকাদের মধ্যে বোলতা, লেগি বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটল, ড্যামসেল ফ্লাই ইত্যাদি। তথাপি ফসলের বেশ কিছু প্রধান ক্ষতিকর পোকাকে আলোকফাঁদ দিয়ে সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বিশেষত ধানের মাজরা পোকা, সবুজ পাতাফড়িং, বাদামি গাছফড়িং বা কারেন্ট পোকা , সাদা পিঠ গাছফড়িং, কমলা মাথা পাতাফড়িং, সাদা পাতাফড়িং, নলি মাছি, পাতা মোড়ানো পোকা, চুঙ্গি পোকা, থ্রিপস, খাটো শুঁড় ঘাসফড়িং ইত্যাদি। সবজি ফসলেরও অনেক পোকা যেমন কাটুই পোকা, সরুই পোকা বা ডায়মন্ড ব্যাক মথ, পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা ইত্যাদি আলোকফাঁদে ধরা পড়ে।
সাধারণত ধানে কাইচ থোড় আসার আগে এসব পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দেয়। আমাদের দেশে এসব পোকামাকড় মারার জন্য কৃষকেরা সাধারণত বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেন। অথচ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ধান চাষে কীটনাশক ব্যবহার করে কৃষকেরা কোনো সুবিধা পান না। উৎপাদন তো বাড়েই না, বরং উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, আর এর পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত হয়। এ ক্ষেত্রে আলোক ফাঁদ প্রযুক্তি ভালো বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কেননা, এতে খরচ কম হয় এবং পরিবেশবান্ধবও বটে।
ফাঁদ তৈরির পদ্ধতি :
আলোকফাঁদ তৈরির কৌশল খুব সহজ। এই ফাঁদ তৈরি করতে গেলে লাগে বৈদ্যুতিক বাতি বা হ্যাজাক বাতি। এখন চার্জার লাইট দিয়ে এক রকম বিনা খরচে সবচেয়ে কার্যকর আলোকফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে। যেখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই সেখানে হ্যাজাক বাতি ও চার্জার লাইট দিয়ে আলোকফাঁদ তৈরি করা ভালো। আলোকফাঁদের জন্য লাগবে পাঁচ ফুট লম্বা সরু তিনটি বাঁশের টুকরা, গুনা তার, একটি প্লাস্টিক বা মাটির বড় জালা/চারি/গামলা এবং পানি। তিনটি বাঁশের মাথা গুনা তার দিয়ে বেঁধে গোড়া ফাঁক করে তিন দিকে দিয়ে সেটিকে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে। নিচে রাখতে হবে পানি ভর্তি গামলা। গামলার পানিতে ডিটারজেন্ট বা কেরোসিন মিশ্রিত করে দিতে হবে অথবা একটু তরল বা গুঁড়া সাবান গুলে দিতে হবে। এতে পানিতে পড়া পোকারা আর উঠতে পারবে না। বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে দিতে হবে বৈদ্যুতিক বাতি, চার্জার বা হ্যাজাক। সেটি জ্বালালেই তার আলোতে পোকারা আকৃষ্ট হয়ে আসতে শুরু করবে। তবে কেউ কেউ গামলা মাটিতে না রেখে কিছুটা উঁচুতে আলোর কাছাকাছি রাখেন। এতে পোকা বেশি মারা পড়ে । সে জন্য বাঁশের তিনপেয়ে খুঁটির সাথে আড়াআড়ি করে তিনটি বাঁশের চটা বা কাঠের বাতা পেরেক দিয়ে মেরে দিতে হবে। এর ওপর থাকবে মাটির চারি বা গামলা। দক্ষিণাঞ্চলে ঘের বা জলি আমন ধানের জমি, যার আশপাশে উঁচু কোনো জায়গা পাওয়া যায় না সেসব জমির মাঝে কোনো ফসলবিহীন ফাঁকা জলাশয় বা নালা থাকলে তার ওপর বাঁশের খুঁটি দিয়ে আলোকফাঁদ টাঙানো যায়। এতে পোকা আলোতে আকৃষ্ট হয়ে পানির মধ্যে পড়ে এবং পানিতে থাকা মাছ সেসব পোকা খায়। তবে পানি তলের উচ্চতা ও আলোর দূরত্ব কাছাকাছি থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে যেসব পোকা আলোতে আকৃষ্ট হয়ে আসবে তা আর উড়ে পালাতে পারবে না। এটি একটি খুবই সাধারণ ফাঁদ। অনেকে বৈদ্যুতিক বাল্বের নিচে একটি টিনের বড় ফানেল পেতে তার নিচে বড় একটা প্লাস্টিকের কৌটা বা বয়াম লাগিয়ে দেয়। এতে আলোতে পোকা আকৃষ্ট হয়ে ফানেলের মধ্যে পড়বে এবং ফানেলের নল বেয়ে নিচে কৌটায় গিয়ে জমা হবে, আর বের হতে পারবে না। সকালে কৌটা খুলে পোকা বের করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে।
ফাঁদ পাতার নিয়ম :
আলোকফাঁদ কখনো ক্ষেতের মধ্যে পাতা যাবে না। পাততে হবে ক্ষেত থেকে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ মিটার দূরে, ফাঁকা জায়গায়, যেখানে কোনো ফসল নেই। তা না হলে পোকারা আকৃষ্ট হয়ে আসবে, সব তো মরে না বা পানিতে পড়ে না। কিছু পোকা আলোকফাঁদের চার দিকে নিচে জমিতে পড়ে সেখানেই বসে থাকে। যদি ফসল থাকে, তবে ওরা তার খুব ক্ষতি করে। আলোকফাঁদ পাততে হবে সন্ধ্যেবেলায়। ফসলের যেকোনো স্তরে পাতা যায়, তবে লক্ষ রাখতে হবে যখন বিভিন্ন শত্রু পোকার কিছু পূর্ণাঙ্গ পোকা ক্ষেতে আসতে শুরু করে তখনই আলোকফাঁদ পাতার উপযুক্ত সময়। ধানগাছের বাড়ন্ত স্তর, বিশেষ করে কুশি স্তরে ঘন ঘন অর্থাৎ প্রতিদিনই আলোকফাঁদ দিলে সবচেয়ে বেশি পোকা ধরা পড়ে ও উপকার বেশি পাওয়া যায়। পোকা গাছে ডিম পাড়া শুরু করার আগেই ওদের দফা রফা করতে পারলে ভালো হয়। বিশেষ করে মথ জাতীয় যেসব পোকা আছে, তা আলোকফাঁদ দেখলেই গাছে বসার আগেই ফাঁদে ছুটে আসে। এর পর সপ্তাহে এক দিন করে চালিয়ে যাওয়া যায়। ধান পুষ্ট হয়ে এলে আর আলোকফাঁদ দেয়ার দরকার হয় না। তবে বাদামি গাছেফড়িংয়ের আক্রমণ অব্যাহত থাকলে আলোক ফাঁদও চালিয়ে যেতে হবে।
সৌরশক্তি চালিত নতুন আলোকফাঁদঃ
বাংলাদেশে ফসলের মাঠে কীটপতঙ্গের উপদ্রপ বেড়েই চলছে। কমে যাচ্ছে ফসলের আবাদও। এ সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে পোকা শনাক্তকরণ, পর্যবেক্ষণ ও দমনের জন্য বর্তমানে সৌরশক্তি চালিত নতুন আলোকফাঁদ উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট।
ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিধান চন্দ্র নাথ বলেন, “সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে আলোক ফাঁদ অটোমেটিক জ্বলে উঠবে এবং দেড় বিঘা জমিতে একটি আলোক ফাঁদ রাখলেই কাজ হবে।”কেননা আলোর আকর্ষণে পোকাগুলো আলোর কাছে আসবে এবং ফাঁদে পড়ে মারা যাবে।
সৌরশক্তি চালিত আলোকফাঁদ স্থাপনের পদ্ধতিঃ
একটা আলোক ফাঁদের জন্য স্বচ্ছ ২০ ওয়াটের একটি সৌর প্যানেল লাগবে। আলোক ফাঁদের নিচে একটি পাত্রে পানি ও কেরোসিন তেল থাকবে। পোকাগুলো কাছে এসে সেখানে পড়বে।”
“১০০ মিটার পর্যন্ত দূর থেকে পোকা আসে তাই এটি নিয়মিত পরিষ্কার করা দরকার হয়না। ৭/৮ দিন পর গিয়ে পানি পরিবর্তন করে মৃত পোকাগুলোকে ফেলে দিলেই হবে।” এ যন্ত্র কৃষকেরা সহজেই কিনতে পারবেন। এই ফাঁদ ব্যবহারের জন্য কৃষকদেরকে সহযোগিতা করা হবে বলেও জানিয়েছেন বিধান চন্দ্র নাথ।
আলোকফাঁদ ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা :
আলোকফাঁদে অনেক পোকা আকৃষ্ট হলেও সব পোকা আসে না। যেমন পামরি পোকা, ছাতরা পোকা, সবুজ শুঁড় লেদা পোকা, বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ইত্যাদি। তা ছাড়া রাতের সব প্রহরে সব পোকা বের হয় না। যেমন মাজরা পোকা ও বাদামি গাছফড়িং সাধারণত সন্ধ্যেবেলা বেশি বের হয়। আবার অমাবস্যা ও পূর্ণিমার ওপরও পোকার গতিবিধি এবং প্রাচুর্য অনেকাংশে নির্ভর করে। যেমন পূর্ণিমা রাতে গান্ধী পোকা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে। আবার অমাবস্যার পর নতুন চাঁদ উঠলে মাজরা পোকা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!