চুকুরের চাষ পদ্ধতি ও বাংলাদেশে চুকুরের বিবিধ সম্ভাবনা
চুকুর উপগুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের ফল। যার ইংরেজি নাম : Rosella, Sorrel এবং বৈজ্ঞানিক নাম : Hibiscus sabdariffa (Linnaeus)। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্য প্রজাতির মেস্তা (এম-৭১৫) থেকে বিশুদ্ধ সারি নিবার্চন ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী একটি উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে এবং জাতীয় বীজ বোর্ড কতৃর্ক ২০১০ সালে বিজেআরআই মেস্তা-২ (সবজি মেস্তা-১) নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। এ জাত চলতি নাম চুকুর হিসেবে সারাদেশে পরিচিত।
এলাকা অনুযায়ী চুকুরের বিভিন্ন নামঃ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ফলটি পরিচিত। যেমন: রাজশাহীতে চুকাই, খুলনায় ও সাতক্ষীরাতে অম্ল বা অম্বল মধু, ধামরাই এবং মানিকগঞ্জে চুকুল, সিলেটে হইলফা, কুমিল্লায় মেডশ, বা মেষ্টা,পাহাড়ি এলাকায় ‘আমিলা ইত্যাদি। এছাড়া চুকুরি, চুপুরি, চুকোর, চুপড়, চুকা, চুক্কি, চুই, মেস্তা, ইত্যাদি নামও প্রচলিত আছে।
চুকুর চাষকৃত এলাকাঃ ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, সিলেট ও অন্যান্য জেলার উর্বর জমিতে মেস্তার ফলন অধিক হয়। অনেক দেশেই এই গাছের বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। বাংলাদেশেও এ ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা সম্ভব। দেশের সর্বত্র এ গাছ জন্মে। আফ্রিকা চুকাই গাছের আদি নিবাস বলে ধারণা করা হয়।
চুকুরের চারিএিক বৈশিষ্ট্যঃ চুকুরের কাণ্ড তামাটে রঙের এবং শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট। কাণ্ড ও পাতায় কোনো কাঁটা থাকে না। পাতা আঙ্গুল আকৃতির, পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো, গাঢ় সবুজ এবং পরিণত অবস্থায় তামাটে লাল রং ধারণ করে। চুকুরের পাতা স্বাদে টক ও সুস্বাদু। পাতার বৃন্ত ১০-১১ সেমি। ১৩০-১৪০ দিনে গাছে ফুল আসে। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিমি, দল হলদে, গোড়ায় মেরুন দাগ রয়েছে। চুকুরের একটি গাছে ৪০-৬০টি ফল ধরে। ফল অপ্রকৃত, ক্যাপসুল আকৃতির, ওপরের দিকে চোখা ও রোমমুক্ত এবং বৃতি পুরু ও মাংসালো। এক হেক্টর জমিতে ৭,৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপাদন হয়। বীজ গাঢ় বাদামী, রেমিফর্ম ও কিডনি আকারের। চুকুরের ১০০০টি বীজের ওজন প্রায় ২০ গ্রাম।
মেস্তা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। খরা সহনশীল ও নেমাটোড প্রতিরোধী মেস্তার চাষে কিছুটা সুবিধা হলো তা শুষ্ক অঞ্চলের প্রান্তিক জমিতে আবাদ করা যায় এবং স্পাইরাল বোরার ও শিকড়ে গিঁট রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় না। মেস্তা বেশ খরা সহিষ্ণু এবং পাটের তুলনায় কম উবর্র জমিতে স্বল্প খরচে এর চাষ করা যায়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে। বীজ থেকে ২০% খাবার তেল পাওয়া যায়।
বীজের হারঃ প্রতি শতক জমিতে ৫০ গ্রাম এর মতো বীজ লাগতে পারে।
বীজ বপন সময়ঃ বৈশাখের প্রথম – শ্রাবনের শেষ (১৫ এপ্রিল – ৩০ জুন) পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়। বীজ (২-২.৫০ফুট) দূরত্বে সারি করে বপন করতে হবে । নাবীতে বীজ বপন করলেও বীজ উৎপাদন করা যাবে। আগাম বীজ বপনে পাতা, বৃতি খাওয়া যাবে ও বীজ উৎপাদন করা যাবে।
ফুল আসার সময়কালঃ ১৩০-১৪০ দিন (৬০ দিন থেকে পাতা এবং ফল আসার পর বৃতি সংগ্রহ করা যায়)
চুকুর চাষের মাটিঃ যে কোনো জেলার উঁচু এবং মধ্যম উঁচু জমিতে চুকুর চাষ করা যায়। দোআঁশ এবং বেলে দোআঁশ মাটি মেস্তা চাষের উপযোগী। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায়, বাড়ির আঙিনা ও আশপাশের জমি, অনুবর্র আবাদযোগ্য প্রান্তিক জমিতে চুকুর চাষ করা যায়। এছাড়া যে সব উঁচু বা টান জমিতে বষার্র পানি জমে থাকে না সেখানেও মেস্তার আবাদ করা যায়। চুকুর চাষের জমিতে প্রকারভেদে আড়াআড়িভাবে দুই-তিনবার চাষ ও মই দিতে হবে।
চুকুর চাষে ক্ষেত্রে চারা তৈরিঃ বীজ দ্বারা সাধারণত চুকুরের চারা তৈরি করা হয়। তবে ডাল কেটে লাগালেও সেসব গাছে দ্রুত ফল ধরে। তবে এ পদ্ধতিতে আমাদের দেশে চুকুরের চাষাবাদ হয় না। জমিতে সরাসরি বীজ বোনা হয়। জুম চাষ করার ক্ষেত্রে সাধারণত মার্চ মাস থেকে এপ্রিল মাসে বীজ বোনা হয়। পাহাড়ের ঢালে ৩-৪টি করে বীজ বপন করতে হবে। বীজ গজানোর পর যখন ২-৩টি করে পাতা বের হবে তখন প্রতি গর্তে ১-২টি চারা রেখে বাকি গুলো তুলে ফেলতে হবে।
সার ব্যবস্থাপনাঃ চুকুর গাছে পাহাড়ে সাধারনত কোনো সার দেওয়া হয় না। তবে অল্প সার দিলে গাছের বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়। তবে সমতলের জন্য নিম্নে হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ দেওয়া হলো-
সারের নাম | সারের পরিমাণ |
গোবর | ১ টন |
ইউরিয়া | ১৩২ কেজি |
টিএসপি | ২৫ কেজি |
এমওপি | ৪০ কেজি |
উক্ত সার মাটির সাথে মিশিয়ে জমি প্রস্তুত করতে হবে। জমিতে দস্তা ও গন্ধকের অভাব দেখা না গেলে জিপসাম ও সালফেট সার প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই। বীজ বপনের ১ মাস পর শতক প্রতি ৫০-৬০ গ্রাম ইউরিয়া পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও পানি নিষ্কাশনঃ প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে। চুকুর পানি সহ্য করতে পারে না। কাজেই বৃষ্টির পানি যাতে না জমতে পারে সেজন্য জমিতে পর্যাপ্ত নালা রাখতে হবে।
আগাছা ও নিড়ানিঃ চারা গজানোর পর প্রয়োজন অনুসারে নিড়ানি ও গাছ পাতলা করে দিতে হবে। গাছ ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়ে গেলে আর আগাছা পরিস্কারের দরকার হয় না। তখন চুকুর গাছের ছায়াতে আর কোনো আগাছা বাড়তে পারে না।
ফলন:
বৃতি: ২.০ – ২.৫ টন/হেক্টর বা ৭.৩৯ – ৯.২৪ মণ/বিঘা;
পাতা: ৬.০ – ৭.০ টন/হেক্টর বা ২২.১৬ – ২৫.৮৫ মণ/বিঘা
ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণঃ ১৩০-১৪০ দিনের মধ্যেই ফুল আসা শুরু হবে। ফুল আসার পরে উপযুক্ত সময়ে ফল পরিপুষ্ট হলে হাত দিয়ে ফল ছিঁড়ে অথবা মাংসল বৃতি সংগ্রহ করা হয়। ফল পাকলে বীজ কেটে ২-৩ দিন রোদে শুকালে বীজ ফেটে যায়। লাঠি দিয়ে হালকাভাবে পিটিয়ে সহজেই বীজ সংগ্রহ করা যায়। পরবর্তী মৌসুমে বপনের জন্য শুকনো বীজ ঠান্ডা করে প্লাষ্টিক অথবা টিনের পাত্রে ভালভাবে রেখে বীজ সংরক্ষণ করা যায়।
চুকুরের বিভিন্ন সম্ভাবনাঃ
- চুকুরের পাতা দিয়ে টক বা খাট্টা রান্না করেও খাওয়া যায়।
- চুকুর পাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়।
- চুকুর পাতা রসুন কাঁচামরিচ ও চিংড়ি মাছ বা অন্য মাছ সহযোগে ভাজি করে অথবা তরকারি রান্না করে খাওয়া যায়।
- ইতালি, আফ্রিকা ও থাইল্যান্ডে চুকুর পাতা দিয়ে ভেষজ চা বানিয়ে খাওয়া হয়।
- এই গাছের কান্ড থেকে ভালো মানের আঁশ পাওয়া যায়। তাই অনেক দেশে পাটের বিকল্প হিসেবে চুকাই গাছ চাষ করা হয়।
- পাতা ধুয়ে সিদ্ধ করে লবণ, ঝাল, রসুন দিয়ে বেটে বাটা চুকুর পাতা ভাত দিয়ে খাওয়া যায়।
- চুকুর পাতার পাপড়ি ধুয়ে সিদ্ধ করে চিনি, তেজপাতা, গরম মশলা দিয়ে জ্বাল দিলেই লাল রঙের জেলি তৈরি করা যায়।
- ব্যাপক চুকুর চাষ করে জেলি উৎপাদন কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে।
- চুকুর গাছ পানিতে পঁচিয়ে আশ তৈরি করা যায়। যা দিয়ে রশি, ছিকা গৃহে ব্যবহার্য বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করা সম্ভব।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!