কাঁকরোল (Teasel gourd) এর আধুনিক চাষ পদ্ধতি ও কৃত্রিম পরাগায়ন
কাঁকরোল ( Teasel gourd ) এক ধরনের কুমড়া গোত্রীয় ছোট সবজি যা মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে বাংলাদেশে চাষ হয়ে থাকে। কাঁকরোল Cucurbitaceae পরিবারের যার ইংরেজি নাম Teasel gourd/spine gourd/kantola এবং বৈজ্ঞানিক নাম Momordica dioica । এর খোসা ছোট ছোট ঘন নরম কাঁটায় ভরা থাকে। ভেতরের শাঁস সাদাটে সবুজ,বিচি নরম ও ছোট। কাঁকরোল গাছের কাঁচা ফল তরকারী, ভাজি বা সিদ্ধ করে ভর্তা হিসেবে খাওয়া হয়। এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, ভিটামিন-বি, শ্বেতসার ও খনিজ পদার্থ ক্যারোটিন আছে। এই সবজির বাজার মূল্যও তুলনামূলক বেশি।
কাঁকরোল লতানো প্রকৃতির গুল্ম জাতীয় গাছ। কাঁকরোলের ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল পৃথক গাছে জন্মে থাকে অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আলাদা। গাছ দেখে সাধারাণত চেনা যায় না কোনটি স্ত্রী ও কোনটি পুরুষ গাছ। ফুল ফোটার পর ফুল দেখে চিনতে হয়। স্ত্রী ফুলের ক্ষেত্রে ফুল মাইকের মতো ফুটে। ফুলের পাপড়ির রং ঘিয়া থেকে সাদাট এবং মাঝখানে খয়েরি রঙের হয়ে থাকে। পুরুষ ফুলের বোটার ওপরে কোনো ফুলের গঠন বা ডিম্বাশয় থাকে না, স্ত্রী ফুলে তা থাকে।
কাঁকরোলের জাতঃ বাংলাদেশে স্থানীয় জাতের বেশ কিছু কাঁকরোল চাষ করা হয়। জাতগুলোর মধ্যে – আসামি, মণিপুরি, মুকুন্দপুরি, মধুপুরি আলমী, টেম্পু, সবুজ টেম্পু ইত্যাদি অন্যতম।
আসামিঃ এই জাতের কাঁকরোলের ফলগুলো গোলাকার, খাটো এবং খেতে সুস্বাদু।
মণিপুরিঃ এই জাতের কাঁকরোলের ফল দেখতে একটু লম্বাটে ও চিকন। তবে ফলন অন্যান্য জাতের তুলনায় বেশি হয়ে থাকে।
কাঁকরোলের চাষ পদ্ধতিঃ
মাটির প্রকৃতিঃ কাঁকরোল চাষের করার জন্য দোঁআশ ও এটেল দোআঁশ মাটি উত্তম। তবে জৈব সার প্রয়োগ করে অন্য মাটিতেও কাঁকরোল চাষ করা যেতে পারে।
জমি তৈরীঃ জমিতে ভালোভাবে ৪-৫ টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে জমির উপরিভাগ সমান করে নিতে হবে। শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে। তারপর চাষকৃত জমিতে প্রয়োজনীয় মাপের বেড তৈরী করে নিতে হবে। জমি অব্যশই আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
কাঁকরোলের মোথা বপনের সময়ঃ কাঁকরোলের বীজ বপন বা মোথা রোপণের উত্তম সময় হলো ফেব্রুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত।
চারা তৈরিঃ বীজ থেকে কাঁকরোলের চারা তৈরি করা যায়। কিন্তু তা না করাই ভালো। কেননা বীজ থেকে মাত্র ৫০% চারা গজাতে পারে। তাছাড়া বীজ থেকে গজানো চারার বেশির ভাগ গাছই পুরুষ গাছ হয়ে থাকে। এছাড়াও বীজ থেকে গজানো গাছের ফলন কম হয় এবং জাতের গুনাগুণ ঠিক থাকে না। সেজন্য কন্দ বা মোথা থেকে কাঁকরোলের চারা তৈরি বা বংশবিস্তার করা হয়। গাছের আগা কেটে বালি বা মাটির মধ্যে ছায়া জায়গায় পুঁতে দিলে ১০-১৫ দিনের মধ্যে চারা হয়। কাটিং এর গোড়ায় রুটিং হরমোন লাগিয়ে দিলে দ্রুত শিকড় গজায়। তবে এতো ঝামেলা না করে জমিতে মাদা তৈরি করে সরাসরি কন্দমুল লাগানো উত্তম।
জমিতে বেড বা মাদা তৈরী এবং কন্দমুল রোপণঃ বেড তৈরির ক্ষেত্রে প্রস্থ নিতে হবে ২ মিটার ও জমির দৈঘ্য অনুযায়ী লম্বা করতে হবে। দুই বেডের মাঝে নালার প্রস্থ ও গভীরতা হবে যথাক্রমে ৩০ সেমি এবং ২০ সেমি। প্রতিটি বেডে ২ টি করে সারি রাখতে হবে। বেডে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২ মিটার। প্রতিটি সারিতে ৬০x৬০x৬০ সেমি আকারের গর্ত মাদা তৈরী করে নিতে হবে।
মাদায় ৪-৬ সেমি গভীরে কন্দমুল পুঁততে হবে। তারপর মাটি দিয়ে মাদা ঢেকে তার ওপর খড় বিছিয়ে দিতে হবে যাতে মাদার মাটি শুকিয়ে না যায়। প্রয়োজনে ২/১ দিন পর পর ঝাঁঝরি দিয়ে মাদায় সেচ দিতে হবে। রস না থাকলে কন্দ গজাবে ন আর বেশি রস থাকলে কন্দ পচে যাবে। মোথা লাগানোর সময় পুরুষ ও স্ত্রী মোথার অনুপাত ঠিক রেখে লাগাতে হবে। সেজন্য ৯ টি স্ত্রী মোথা লাগানোর পর ১ টি পুরুষ মোথা লাগাতে হবে। পুরুষ গাছে স্ত্রী গাছের তুলনায় দেরিতে ফুল আসে। তাই স্ত্রী গাছের মোথা লাগানোর ১৫-২০ দিন আগে পুরুষ গাছের মোথা লাগাতে হবে।
রোপণ দূরত্বঃ সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ২ মিটার ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ২ মিটার। আবার মাদা থেকে মাদার দূরত্ব হবে ২.৫ মিটার।
কাঁকরোল চাষে সার ব্যবস্থাপনাঃ কাঁকরোল গাছের নিয়মিত বৃদ্ধি ও ভালো ফলন পাওয়ার জন্য নিম্নোক্ত হারে সার প্রয়োগ করতে হবেঃ
সারের নাম | মোট পরিমাণ( প্রতি শতকে) | জমি তৈরির সময়(প্রতি শতকে) | প্রতি মাদায় | ||||||
কন্দ রোপণের ৭-১০ দিন আগে | কন্দ রোপণের ১০-১৫ দিন পরে | কন্দ রোপণের ৩০-৩৫ দিন পরে | কন্দ রোপণের ৫০-৫৫ দিন পরে | কন্দ রোপণের ৭০-৭৫ দিন পরে | |||||
গোবর সার | ৮০ কেজি | ২০ কেজি | ১০ কেজি | – | – | – | – | ||
টিএসপি | ৭০০ গ্রাম | ৩৫০ গ্রাম | ৬০ গ্রাম | – | – | – | – | ||
ইউরিয়া | ৭০০ গ্রাম | – | – | ৩০ গ্রাম | ৩০ গ্রাম | ৩০ গ্রাম | ৩০ গ্রাম | ||
এমওপি | ৬০০ গ্রাম | ২০০ গ্রাম | ৫০ গ্রাম | – | – | – | – | ||
জিপসাম | ৪০০ গ্রাম | ৪০০ গ্রাম | – | – | – | – | – | ||
দস্তা সার | ৫০ গ্রাম | ৫০ গ্রাম | – | – | – | – | – | ||
বোরন | ৪০ গ্রাম | ৪০ গ্রাম | – | – | – | – | – | ||
ম্যাগনেশিয়াম সালফেট | ৫০ গ্রাম | – | – | – | – | – | – | ||
কাঁকরোল চাষে অন্যান্য প্রযুক্তিঃ
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যাঃ
- মোথা গজানোর পর আগাছা জন্মালে তা দমন করতে হবে।
- নালার সাহায্যে জমিতে পানি সেচ দিতে হবে।
- অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- প্রতিদিন ভোরবেলা স্ত্রী ফুলে কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হবে।
- রোগ ও পোকার আক্রমন দেখা দিলে তা দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- কাঁকরোলের গাছ ১০-১৫ সেমি লম্বা হলে চারার গোড়ায় ১ টি করে কাঠি পুঁতে দিতে হবে।
- গাছ ৫০ সেমি লম্বা হলে বাউনির জন্য মাচা তৈরি করে দিতে হবে।
পরাগায়নঃ কাকরোলে প্রাকৃতিকভাবে পরাগায়ন খুব কম হয়। তাই ভালো ফলনের জন্য কাকরোল ফুলের কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হয়। ফুলের কৃত্রিম পরাগায়ন পদ্ধতি নিম্নরূপ-
- সকাল ৬ টার দিকে সদ্য ফোটা পুরুষ ফুল বোটাসহ কেটে নিয়ে সতেজ রাখার জন্য ফুলগুলোর বোটা পানির ভেতর ডুবিয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিতে হবে।
- এরপর পুরুষ ফুলের পুংকেশর ঠিক রেখে পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে। এতে কৃত্রিম পরাগায়নের কাজ সহজ হবে।
- তারপর স্ত্রীফুলের গর্ভমুন্ডের ওপর পুরুষ ফুলের পুংকেশর বা পরাগধানির রেণু বা হলদে গুড়া খুব আস্তে আস্তে ২-৩ বার স্পর্শ করাতে হবে। এই কাজটি স্ত্রী ফুল ফোটার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই করতে হবে। এর ফলে গর্ভমুণ্ডে রেনু আটকে যাবে ও পরাগায়ন হবে। সাবধনতা অবলম্বন করলে ১ টি পুরুষ ফুল দিয়ে ৬-৭ টি স্ত্রী ফুলে কৃত্রিম পরাগায়ন সম্ভব।
রেটুন কাকরোলঃ
শীতের শুরুতেই কাকরোল গাছ মরে যায় এবং পরবর্তী বর্ষা না আসা পর্যন্ত মাটির নিচে মোথা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, যা থেকে পরের বছর আবার সঠিকভাবে যত্ন নিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এভাবে কাঁকরোল চাষ করলে বীজের খরচ, রোপণ এবং রোপণ পরবর্তী খরচ অনেকাংশে কমে যায় এবং বেশি লাভবান হওয়া যায়।
ফসল সংগ্রহঃ কাঁকরোল হলদে সবুজ হলে একটা একটা করে কেটে বা ছিঁড়ে সংগ্রহ করতে হয়। মোথা লাগানোর ৩০-৬০ দিনের মধ্যে স্ত্রী গাছে ফুল ফুটোতে শুরু করে। চারা গজানোর ৬০-৭০ দিন পর কাঁকরোল তোলা শুরু করা যায়। কাঁকরোল গাছে পরাগায়নের ১২-১৫ দিনের মধ্যে কাঁকরোল সংগ্রহের উপযোগী সময়।
জীবনকালঃ কাঁকরোল গাছের জীবনকাল ১৩০-১৫০ দিন।
ফসল সংগ্রহের সময়ঃ মধ্য জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কাঁকরোল সংগ্রহের উপযোগী সময়।
ফলনঃ উপযুক্ত পরিচর্যা নিলে জাতভেদে হেক্টরপ্রতি কাঁকরোলের ২৫ থেকে ৩০ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। আবার শতক প্রতি ১০০-১২০ কেজি কাঁকরোলের ফলন পাওয়া যায়।
1955 total views, 1 view today
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!