সবুজ সার তৈরি পদ্ধতি। সবুজ সার প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত ফসলের বৈশিষ্ট্য
সবুজ সার বলতে সাধারণত জমিতে কোন শস্য বপন করে তা সবুজ অবস্থায়ই আবার সে জমিতে মিশিয়ে দিয়ে যে সার তৈরী তাকে বোঝায়। সবুজ সার বিভিন্ন উপায়ে মাটির উর্বরতা বাড়াতে সহায়তা করে।
সবুজ সার তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য হলো মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করা। যে সকল গাছের শিকড় মাটির গভীরে ছড়িয়ে যায়, অল্প পরিচর্যায় দ্রুত বেড়ে উঠে এবং অধিক পরিমাণে জৈব পদার্থ উৎপাদন করে সবুজ সার তৈরিতে ঐসব গাছ বেছে নেওয়া উচিত। গাছ জমিতে জন্মানোর পর যখন তাতে ফুল ধরা শুরু হয় তখনই তা চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। বৃষ্টির পানিতে তা ধীরে ধীরে পচতে থাকে। পরবর্তী সময়ে কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ওলট পালট করে দিলে গাছের বাকী অংশ আরো ভালোভাবে মাটির নীচে পড়ে এবং পচে মাটির সাথে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং এর বুনট উন্নত করে।
শিমজাতীয় গাছ ধইঞ্চা, শন এবং মটরশুটি সাধারণত আমাদের দেশে সবুজ সার প্রস্তুত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। শুটি জাতীয় বিধায় এ ফসল জমিতে শুধু জৈব পদার্থই যোগ করে না, উদ্ভিদের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যপাদান নাইট্রোজেনও যোগ করে থাকে। এ জাতীয় গাছের শিকড়ে এক রকম গুটির সৃষ্টি হয়। তাতে মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া বাস করে এবং বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে। জীবাণুদেহের এ নাইট্রোজেন পরবর্তী সময়ে মাটিতে সঞ্চিত হয়ে ফসলের গ্রহণোপযোগী হয়। কখনো কখনো কাউপি বা বরবটি এই কাজে ব্যবহৃত হয়। অ-শিমজাতীয় গাছের মধ্যে রাই, সরগম, ভূট্টা প্রভৃতি অন্যান্য দেশে সবুজ সারের জন্য চাষ করা হয়।
সবুজ সার প্রস্তুতের জন্য যে সমস্ত ফসল ব্যবহার করা হয় সেগুলির বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ
ক) গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হবে ও অনুর্বর মাটিতে জন্মানোর ক্ষমতা থাকবে হবে।
খ) গাছের অনেক ডালপালা ও পাতা থাকবে।
গ) গাছ তাড়াতাড়ি পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে।
ঘ) গাছের কান্ড নরম ও দ্রুত পচনশীল হবে।
ঙ) গাছের শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতাসম্পন্ন হবে। এ জন্য মাটির নীচের স্তরের খাদ্যোপাদান সে শিকড়ের শোষণের ফলে উপরে উঠে আসে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা সবুজ সারের সঙ্গে মাটির উপরিস্তরে জমে ফসলের ব্যবহারোপযোগী হবে এবং
চ) যতদূর সম্ভব গাছ সোলানেসী পরিবারভূক্ত হবে।
জমিতে খাদ্য উপাদান যোগঃ সবুজ সার ব্যবহার করার মুখ্য উদ্দেশ্য হল জমিতে জৈব পদার্থ যোগ করা সবুজ সারের জন্য শিমজাতীয় গাছ যখন ব্যবহার করা হয় তখন জমিতে কেবল নাইট্রোজেনই যোগ হয় না অন্যান্য খাদ্যোপাদান ফসফরাস, পটশিয়াম ও ক্যালসিয়ামেরও যোগ সাধন হয়। নিন্মে সবুজ সারজাতীয় শস্যের খাদ্যেপাদানের পরিমাণের একটি তালিকা উল্লেখ করা হলো-
সবুজ সারজাতীয় শস্যের খাদ্যেপাদানের পরিমাণঃ
সবুজ সার জাতীয় শস্য | নাইট্রোজেন | ফসফেট | পটাশ | ক্যালসিয়াম |
শন | ০.৭৫% | ০.১২% | ০.৫১% | ০.৩৯% |
বরবটি | ০.৭১% | ০.১৫% | ০.৫৮% | ০.৬৪% |
মুগ ডাল | ০.৭২% | ০.১৮% | ০.৫৩% | ০.৭৬% |
মাসকলাই | ০.৮৫% | ০.১৮% | ০.৫৩% | ০.৭৪% |
সবুজ সারের প্রস্তুতিঃ আমাদের দেশে দুটি সুপরিচিত শস্য রয়েছে যা সবুজ সার তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। শস্য দুটি হচ্ছেঃ
(১) ধইঞ্চা ও
(২) শন।
নিচু জমিত ধইঞ্চা জন্মানো হয় আর মাঝরী হতে উঁচু জমিতে জন্মানো হয় শন। এর কারণ ধইঞ্চা পচার জন্য যথেষ্ট্য পরিমাণ পানির দরকার হয়। নিচু জমিতে পানির অভাব হয় না। শন পচবার জন্য ধইঞ্চার মতো তত বেশি পানির প্রয়োজন হয় না। মাঝরি জমিতে যে পানি জমে তাতেই শন পচে যায়।
ধইঞ্চাঃ একটি শিমজাতীয় গাঢ় সবুজ রঙের গাছ। এ গাছে যথেষ্ট পাতা জন্মাতে দেখা যায়। এটি তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় ও অল্প সময়ে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। ধইঞ্চা জন্মাবার জন্য জমিতে তত চাষের দরকার হয় না, দুই একটি চাষ দিলেই চলে। কোন রকম সার দেওয়ার প্রয়োজন হয় না, তবে ফসফেট ও পটাশ হেক্টর প্রতি যথাক্রমে ১৭ ও ১১ কেজি হিসাবে প্রয়োগ করলে গাছের শিকড়ের গুটিতে অধিক পরিমাণ নাইট্রোজেন সঞ্চিত হয়। সার দুটির অধিকাংশ অংশ পরবর্তী ফসলেরও বিশেষ উপকারে আসে। হেক্টর প্রতি ৩৫-৪৭ কেজি হিসাবে বপন করিলে ধইঞ্চার চারা ঘন হয়ে জন্মে যে তাতে আগাছা জন্মাবার মতো কোন ফাঁকা পায় না বা জন্মালেও তা গাছের নিচে চাপা পড়ে যায়। তাই বলার প্রয়োজন নেই যে ফসলটির চাষে কোন রকম বাড়তি পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না।
বপনের পর দুই হতে আড়াই মাসের মধ্যে গাছে ফুল ধরতে শুরু করে, তখনই বুঝতে হবে ফসল পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়ে সবুজ সার প্রস্তুতির জন্য উপযোগী হয়েছে। এ সময়ই লাঙ্গল দ্বারা চাষ করে গাছগুলি মাটির নীচে ফেলতে হয়। গাছ বেশী লম্বা হয়ে পড়লে তা চাষের আগে কাস্তে বা হাসুয়া দ্বারা কেটে টুকরা টুকরা করে দিলে ভালো হয়, কারণ লাঙ্গলে আটকিয়ে চাষের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বর্ষা শুরু হলে মাটিতে অনেক পানি জমে। সে অবস্থায় ১০/১২ দিন পর পর ২/৩ টি চাষ দিলেই গাছ সম্পূর্ণরূপে পচে মটির সাথে মিশে যায় অর্থাৎ বলতে হয় ধইঞ্চার সবুজ সার প্রস্তুত করে জমিতে প্রয়োগ করা হয়।
ধইঞ্চার সাহায্যে সবুজ সার প্রস্তুতের পর আমাদের দেশে প্রায় জমিতেই রোপা আমন ধান লাগান হয়। এটি বেশ লাভজনক, তবে কোন কোন সময় তামাক ও গোল আলুর চাষও করা হয়।
শনঃ ইহাও শিম-পর্যায়ভূক্ত উদ্ভিদ; মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট ও ফিকে সবুজ রঙের একটি দ্রুতবর্ধনশীল শস্য। অল্প সময়েই গাছ পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং তাতে বড় বড় হলুদ রঙের ফুল ধরে।
ধইঞ্চার মতো করে জমি চাষ করলেই চলে অর্থাৎ গোটা দুয়েক চাষ দিলেই চলে। কোন রকম সার ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না, তবে হেক্টর প্রতি ১৭ কেজি ফসফেট ১১ কেজি পটাশ প্রয়োগ করিলে বর্তমান ও পরবর্তী ফসলের জন্য বেশ ভালো ফল পাওয়া যায়। তাই নিড়ানি দিয়ে ঘাস বা আগাছা পরিষ্কার করার দরকার নাই। মালচিং, পানি সেচ ইত্যাদি অন্যন্য মধ্যবর্তী ফসল পরিচর্যারও কোন প্রয়োজন হয় না।
দুই হইতে আড়াই মাসের মধ্যে যখন গাছে ফুল ধরতে থাকে তখন লাঙ্গল দিয়ে গাছগুলো মাটি চাপা দিতে হয়। পর পর কয়েকবার চাষ ও মই দিলে পানির সান্নিধ্যে গাছ মাসখানেকের মধ্যে পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
শনের সাহায্যে সবুজ সার করার পর যে যে ফসলের চাষ করা হয় সেগুলি হচ্ছে আখ, তামাক, আলু এবং বিলাতী সবজি।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!