সামুদ্রিক শৈবাল চাষে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও শৈবালের পুষ্টিগুণ
সামুদ্রিক শৈবাল আসলে কি? এ সম্পর্কে যদি একটু বলতেন?
সামুদ্রিক শৈবাল হলো সমুদ্রের অগভীর অঞ্চলে শিকড়, ডালপালা, পাতা ও ফুলবিহীন সালোক-সংশ্লেষণকারী এক ধরণের উদ্ভিদ, যা সী-উইড নামেও পরিচিত। শৈবাল সাধারণত উপকূলীয় সামুদ্রিক এলাকার পাথর, বালি, কাদা, খোলস বা অন্যান্য শক্ত অবকাঠামোতে জন্মায়। এটি লাল, বাদামী ও সবুজ এই তিন ধরণের হয়ে থাকে। বাদামী এবং সবুজ সামুদ্রিক শৈবাল সাধারণত খাওয়া যায়, অন্যদিকে বাদামি এবং লাল হাইড্রোকলয়েড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং মোহনা অঞ্চলগুলোতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭৭ প্রজাতির শৈবাল রেকর্ড করা হয়েছে। মূলত নভেম্বর থেকে এপ্রিল এই ছয় মাস সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশে শীতকাল বৃষ্টিহীন ও সাগরের পানির লবনাক্ততা বেশি থাকায় শৈবাল চাষের জন্য উৎকৃষ্ট সময়।
১৬৪০ সালের দিকে টোকিও উপসাগরে সর্বপ্রথম শৈবাল চাষ শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে প্রথম এর চাষ শুরু হয়েছিল ১৯৪০ সালে। বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক শৈবালের ব্যাপক চাহিদার জন্য ১৯৭০’র শুরুর দিকেই বিপ্লব ঘটে শৈবাল চাষে। বর্তমানে এর বৈশ্বিক চাহিদা ২৬ মিলিয়ন টন। যার বাজারমূল্য ৬.৫ বিলিয়ন ডলার।
শৈবালের পুষ্টিগুণসহ কি কি কাজে সামদ্রিক শৈবাল ব্যবহৃত হয় সেগুলো যদি আমাদেরকে জানাতেন?
শৈবাল খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়োডিন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন ‘কে’ এবং ভিটামিন ‘ডি’। লাল ও বাদামি বর্ণের শৈবালে ক্যারোটিন নামে এক ধরনের উপাদান আছে, যা মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। মানবদেহের উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। ডায়রিয়া এবং টিউমার বৃদ্ধি রোধ করে।
স্পিরুলিনা শৈবাল দেহের হজম শক্তি বৃদ্ধি, রোগজীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। বাংলাদেশে দশ লাখেরও বেশি মানুষ গলগন্ড রোগে ভুগছে। অধিকাংশ শৈবালে সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশি আয়োডিন রয়েছে, যা ওষুধ বা লবণ থেকে হতে পারে সমৃদ্ধ বিকল্প। শৈবাল বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, প্রসাধনীসহ বায়োগ্যাস ও জৈব সার উৎপাদন, সমুদ্রের দূষণ রোধেও ভূমিকা রাখে। শৈবালের পাঁচটি প্রজাতি থেকে গাড়ি, বিদ্যুৎ ও হেলিকপ্টারের জ্বালানি তৈরি করা যায়। শৈবাল পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
সামুদ্রিক শৈবাল চাষে বাংলাদেশ কেন সম্ভাবনাময়?
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং বিশাল উপকূলীয় এলাকা শৈবাল চাষের জন্য উপযুক্ত। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও বাগেরহাট জেলার উপকূলীয় অঞ্চলগুলো শৈবাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়াও, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ এলাকা শৈবাল চাষের সবচেয়ে উপযুক্ত, যেখানে পরিকল্পিত ও বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারের সমুদ্র অর্থনীতি কার্যক্রমে সামুদ্রিক শৈবালকে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহ্পরীর দ্বীপ ও জালিয়াপাড়া এলাকায় নাফ নদীর তীর, উখিয়ার ইনানী এলাকার রেজু খালের তীরে এবং নুনিয়ারছড়াতে শৈবাল চাষ হচ্ছে। সেন্টমার্টিন অঞ্চলের লোকজন হেজেলা বা সামুদ্রিক শৈবাল সংগ্রহ করে অল্প দামে বিক্রি করছে পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। আর মিয়ানমার থেকে তা চলে যায় চীন, কোরিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
শৈবালভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবেই উপকূলীয় অঞ্চলে শৈবাল চাষের জন্য বিপুল পরিমাণ খালি জমি রয়েছে। শৈবাল চাষে খরচ কম কিন্তু আয় অনেক বেশি, যা বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত উপজেলার বাসিন্দারা বেশির ভাগই মৎস্য আহরণ, বিপণন ও মৎস্য সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এদের বিকল্প আয়ের বড় একটি উৎস হতে পারে শৈবাল চাষ। তাই আমি মনে করি সামুদ্রিক শৈবাল চাষ বাংলাদেশের জন্য খুবই সম্ভাবনাময়।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!