সুপারি গাছের পরিচর্যা এবং রোগবালাই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য
সুপারি গাছের রোপণে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। তেমন কোন পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে এবটি সুপারি গাছ থেকে বছরে এক-দেড় হাজার টাকার সুপারি পাওয়া সম্ভব। অতি খরা কিংবা অতি বর্ষণ সব ধরণের প্রাকৃতিক প্রতিকুল পরিবেশেই সুপারি গাছ বেড়ে উঠতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুপারি গাছের সঠিক পরিচর্যা নেয় না। যার ফলে গাছ বড় হলেও স্বাভাবিক ফল ধারণ বিঘ্নিত হয়। আবার অনেক সময় পরিচর্যার অভাবে সুপারি গাছ নানা রোগে আক্রামত হয়ে মরে যায়। তাই সুপারি গাছের স্বভাবিক বৃদ্ধি এবং ফল প্রাপ্তির জন্য সঠিক পরিচর্যা আবশ্যক।
সুপারি গাছের পরিচর্যাঃ সুপারি গাছের পরিচর্যা করতে হয় বছরে ২ বার। প্রথম বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে এবং ২য় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। সুপারি গাছ থেকে ভালো ফলন পেতে গাছের বয়স এক বছর হলে প্রতি গাছের জন্য ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০০ গ্রাম এমওপি সার ২ ভাগ করে এক ভাগ বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক সার ভাদ্র-আশ্বিন মাসে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ২ বছর হলে ৪০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২০০ গ্রাম টিএসপি এবং ২০০ গ্রাম এমওপি একই ভাবে দুইভাগ করে একভাগ শুস্ক মৌসুমে অপর অংশ বর্ষায় প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৩ বছর হলে ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপি সার একইভাবে দুই কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স ৪-১০ বছর হলে ৬০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৩০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৩০০ গ্রাম এমওপি সার অনুরূপভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
সুপারি গাছে মুচি আসার আগে অর্থাৎ মধ্য চৈত্র থেকে মধ্য বৈশাখ এর মধ্যে গাছের গোড়ার চারিদিকে ২ ফুট দুরত্বে ১ ফুট চওড়া ৬ ইঞ্চি গভীর করে মাটি সরিয়ে ফেলতে হবে। পরবর্তীতে ওই মাটির সাথে ৭০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ৮০০ গ্রাম এমওপি, ৩০০ গ্রাম জিপসাম এবং ১০০ গ্রাম জিংক মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। সার মিশ্রিত ওই মাটি দিয়ে পুনরায় গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। সার প্রয়োগের একদিন আগে প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। যাতে করে ওই মাটিতে তিন দিন পর্যাপ্ত রস থাকে। এছাড়া ফলন্ত গাছের গোড়ায় বছরে একবার ১০ কেজি কম্পোষ্ট অথবা ১০ কেজি কেঁচো সার প্রয়োগ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় সুপারি গাছের পরিচর্যা করা হলে গাছ হবে সতেজ এবং পর্যাপ্ত ফল দিবে।
সেচঃ বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি না হলে গাছের গোড়ায় প্রয়োজনীয় পানি/সেচ দিয়ে গাছের গোড়া থেকে ১ ফুট দুরত্বে নিড়ানী দিয়ে মাটি কিছুটা আলগা করে সার ছিটিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের পর গাছের গোড়ায় যাতে প্রয়োজনীয় রস থাকে সে জন্য খড় বা বিচালী বিছিয়ে দিতে হবে।
রোগ বালাই ব্যবস্থাপনাঃ সুপারি গাছ ও ফল বিভিন্ন প্রকার রোগ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়। ভালো ফলন পেতে হলে রোগবালাই ব্যবস্থাপনা একান্ত অপরিহার্য। প্রধান প্রধান রোগবালাই ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উল্লেখ করা হলো।
সুপারি পচা ( Nut rot ) রোগঃ রোগের আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত সুপারির বোঁটায় পানি ভেজা ছোপ ছোপ দাগ পড়ে এবং আস্তে আস্তে অনেকগুলো দাগ একত্রে মিশে বড় আকার ধারণ করে। আক্রান্ত স্থান ক্রমান্বয়ে বাদামী ও ছাই রংয়ের হয়ে এক সময় পূরো সুপারিটাই রোগাক্রান্ত হয়ে যায়। আক্রান্ত স্থানের টিস্যু পচে কালো হয়ে যায়। আক্রান্ত ফলগুলো পচে ঝরে পড়ে।
দমন ব্যবস্থাপনাঃ বর্ষা মৌসুমের শুরুতে একবার এবং মাঝামাঝি সময়ে আর একবার মোট ২ বার বোর্দো মিক্সচার (প্রতি লিটারে ১০ গ্রাম তুতে ও ১০ গ্রাম চুন) স্প্রে করতে হবে। গাছে মোচা বের হওয়ার কিছু আগে মেনকোজেব ( ডাইথেন এম ৪৫) অথবা মেটালেক্সিল+মেনকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন-রিডোমিল গোল্ড) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর গাছে ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
কুঁড়ি পচা রোগঃ এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। এ ক্ষেত্রে ছত্রাক জীবাণু মোচার গোড়ায় কাণ্ডের সংযোগ স্থলের নরম টিস্যু আক্রমণ করে। আক্রান্ত স্থানের টিস্যু প্রথমে হলুদ ও পরবর্তীতে বাদামী রঙ ধারণ করে এবং শেষ পর্যায়ে পচে কালো হয়ে কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই আক্রান্ত স্থান চেছে ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু পরিষ্কার করে বোর্দো পেস্ট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত স্থান ব্যান্ডেজ করে দিতে হবে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাছের পাতা ও মোছায় ১% বোর্দো মিক্সার অথবা ১.৫% কুপ্রাভিট ১৫-২০ দিন অন্তর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। মৃত গাছ, ফলপচা রোগে আক্রান্ত মোচা ও ফল সরিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে এবং বাগানের সমস্ত গাছে ১% বোর্দো মিক্সার অথবা কুপ্রাভিট স্প্রে করে সকল গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে।
মোচা শুকিয়ে যাওয়া ও কুড়ি ঝরাঃ এ রোগটি প্রধানত গ্রীষ্মকালে হয়ে থাকে। রোগের আক্রমণে আক্রান্ত মোছার গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত হলুদ হয়ে যায়, পরবর্তীতে গাঢ় বাদামী রঙ ধারণ করে এবং পুরো মোচাটি শুকিয়ে যায়। ফলে আক্রান্ত মোচার কুঁড়িগুলো ঝরে পড়ে।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছের মোচা কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই ডায়থেন এম-৪৫ অথবা নোইন নামক ছত্রানাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হিসেবে গাছে মোচা বের হলেই ১৫ দিন পরপর ৪-৫ বার স্প্রে করতে হবে।
মাকড়ঃ সুপারি গাছ কয়েক ধরনের মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয় যেমন-লাল মাকড়, সাদা মাকড়, হলদে মাকড়। সকল বয়সের সুপারি গাছই লাল ও সাদা মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ পোকা পাতার রস চুষে খায়। ফলে আক্রান্ত পাতা প্রথমে হলুদ ও পরে তামাটে রঙ ধারণ করে এবং পরবর্তীতে শুকিয়ে যায়। আস্তে আস্তে পুরো পাতাই শুকিয়ে যায়, গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থাপনাঃ এ মাকড় দমনের জন্য প্রতি লিটার পানিতে ১.৫-২ মিলি ‘ক্যালথেন’ অথবা নিউরোল মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে ১০-১৫ দিন পরপর ২৩ বার স্প্রে করতে হবে।
শিঁকড়ের পোকাঃ এ পোকার কীড়া বা বাচ্চা গাছের শিকড়ে আক্রমণ করে। এরা প্রথমে গাছের কচি ও নরম শিকড় খেতে শুরু করে। অতঃপর গাছের শক্ত ও পুরানো শিকড় খেয়ে ফেলে। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায়, উপরের কাণ্ড চিকন হয়ে আসে এবং ফলন কমে যায়।
প্রতিকারঃ এ পোকার আক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলেই গাছের চারপাশে ১ মিটার ব্যসার্ধে হালকা করে কুপিয়ে কার্বোফুরান ৩ জি অথবা ফুরাডান ৫ জি গাছ প্রতি ১০ গ্রাম হারে ছিটিয়ে পানি সেচ দিতে হবে এবং মালচিং করে দিতে হবে। বছরে দু’বার অর্থাৎ বর্ষার আগে ও পরে এভাবে মালচিং করে দিতে হবে। তাহলে এ পোকার আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!