সয়াবিনের পোকামাকড় ও রোগসমুহ। ফসল সংরক্ষণ পদ্ধতি
সয়াবিনের পোকামাকড় ও রোগসমুহ
বিছা পোকাঃ
লক্ষণঃ বিছা পোকা গাছের পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতা ঝাঝরাঁ করে ফেলে।
গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন কমে যায়।
প্রতিকারঃ
- আক্রান্ত পাতাগুলি সংগ্রহ করে পায়ে বা হাতে নিয়ে পিষে মেরে ফেলতে হবে।
নিয়মিত জমি দেখাশোনা করতে হবে। - বুস্টার/রিপকর্ড/সাইপারমেথ্রিন গ্রুপের কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি এবং মর্টার ৪৮ ইসি ১ মিলি বা এগফস/ক্লোরোপাইরিফস ২মিলি একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফল ছিদ্রকারী পোকাঃ
লক্ষণঃ এই পোকার শুককীট প্রথমে পাতার সবুজ অংশ খায়। তারপর কুঁড়ি, ফুল এবং শুঁটি আক্রমণ করে। শুককীটগুলি শুঁটি ছিদ্র করে শরীরের অর্ধেক অংশ শুঁটির ভিতরে ঢুকিয়ে কুরেকুরে বীজ খায়।
প্রতিকারঃ
- শুককীট দেখা দিলে হাত দিয়ে ধরে পিষে মারতে হবে অথবা কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারতে হবে।
- প্রতি গাছে দুই বা তার বেশি শুককীট দেখা দিলে রিপকর্ড ১০ ইসি বা বুস্টার ১০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি মিশিয়ে এই পোকা দমন করা যায়।
পাতা মোড়ানো পোকাঃ
লক্ষণ ও প্রতিকারঃ সয়াবিন গাছের কিছু কিছু পাতা মোড়ানো পোকা দেখা যায়। সেগুলোর ভিতর একটি করে কীড়া থাকে ও এরা পাতার রস খায়।
মোড়ানো পাতাগুলো হাত দিয়ে ছিঁড়ে পা দিয়ে ডলে শেষ করা যায়।
মাজরা পোকাঃ
লক্ষণঃ জমিতে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ বয়সের কিছু গাছ মরে যাচ্ছে বা শুকনো দেখা যেতে পারে।
গাছগুলোর কান্ডের ভিতর এ পোকার একটি কীড়া থাকে ও এরা কান্ডের ভিতরের অংশ খায়, ফলে গাছ মরে যায়।
প্রতিকারঃ ১০ লিটার পানিতে ১৫ থেকে ২০ মিলি সুমিথিয়ন, অথবা ৩০ থেকে ৪০ গ্রাম ফিলটাপ/এগ্রিটাপ ও ১০ মিলি বুস্টার/রিপকর্ড একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গার্ডেন বিটলঃ
লক্ষণঃ এ পোকা গাছের কান্ডের মাঝামাঝি দুটি মুখোমুখি রিং তরী করে ও কান্ডের ভিতর ঢুকে ভিতরের অংশ খায়। বাতাস বা অন্য কিছুর স্পর্শে রিং এর উপরের অংশ ভেঙ্গে পড়ে ও গাছ মরে যায়।
প্রতিকারঃ স্টার্টার নামক কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রোগবালাই
কান্ড ও গোড়া পচা রোগঃ এটি একটি ছত্রাক জাতীয় রোগ।
লক্ষণঃ
- এ রোগের আক্রমণের ফলে গাছের পাতা হলুদ হয়ে যায়।
- আক্রান্ত গাছের কান্ড ও মূলে কালো দাগ দেখা যায়।
- আক্রান্ত চারা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা যায়।
প্রতিকারঃ
- মাটির উপরে অবস্থিত ছত্রাককে গভীর চাষের মাধ্যমে নষ্ট করতে হবে।
- পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করতে হবে।
- ফসলের অবশিষ্ট অংশ এবং আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
- আক্রান্ত গাছের গোড়ার মাটি ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে) দিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার ভিজিয়ে দিতে হবে।
মোজাইক রোগঃ জাব পোকা এবং কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষকের মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার ঘটে।
লক্ষণঃ পাতার উপরিভাগে সোনালী বা হলুদ রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়।
আক্রান্ত গাছ সাধারণত খাটো হয়ে থাকে।
প্রতিকারঃ
- আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্র তুলে মাটির নীচে পুতে ফেলতে হবে।
- বালাই সহনশীল জাতের চাষ করতে হবে।
- জাব পোকার মাধ্যমে এই রোগের বিস্তার ঘটে বলে প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাব পোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলে দিতে হবে।
- নিম বীজের দ্রবন (১ কেজি পরিমাণ অর্ধভাঙ্গা নিম বীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) বা সাবান গুলানো পানি ( প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুঁড়া সাবান মেশাতে হবে) স্প্রে করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়।
এছাড়াও প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি ন্যকফেন ২০ ইসি বা ফেনডিথিয়ন ২০ ইসি বা স্টার্টার/পারফেকথিয়ন ৪০ ইসি মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফসল সংগ্রহের পর করণীয়ঃ
- সয়াবিন গাছ হলুদ হয়ে পাতা ঝরে যাবার পর গাছ কেটে এনে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
- ৩ থেকে ৪ দিন ভালোভাবে রোদ্রে দিয়ে লাঠি দিয়ে হালকাভাবে পেটালেই সয়াবিন দানা গাছ হতে আলাদা হয়ে যায়।
- সয়াবিন ভালোভাবে মাড়াই, ঝাড়াই ও রোদ্রে শুকানোর পর (৩ থেকে ৪ দিন রোদ্রে শুকাতে হবে) গ্রেডিং করে গুদামজাত করতে হবে।
- মাড়াইয়ের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন অন্য জাতের সাথে মিশে না যায়।
- মাটি, খর, ময়লা ইত্যাদি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
- ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য পণ্যের উজ্জ্বল রং এবং সাইজ যাতে ভালো হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- বাতাস যাতে ঢুকতে না পারে এমন পাত্রে সয়াবিন সংরক্ষণ করতে হবে।
সংরক্ষণ পদ্ধতিঃ
- সয়াবিন পরিষ্কার চাতালে বা চাটাইয়ের উপর পর পর ৩ থেকে ৪ দিন রোদ্রে শুকাতে দিতে হবে।
- সয়াবিন দুপুরের কড়া রোদে না শুকানো ভালো।
- সয়াবিন শুকানোর পর ঠান্ডা হলে ভালোভাবে পরিষ্কার করে মাটির পাত্র/প্লাষ্টিক ড্রাম/ পলিথিন ইত্যাদিতে ভরে সংরক্ষণ করতে হবে।
- পোকামাকড়ের হাত হতে রক্ষার জন্য পাত্রের নিচে ও উপরে শুকনো নিম পাতা বা বিষকাটালীর পাতা গুঁড়া করে দিতে হবে।
- খেয়াল রাখতে হবে পাত্র যেন কোনোক্রমেই ফাঁকা না থাকে।
বীজ সংরক্ষণঃ বীজ শুকানোর পর সংরক্ষণের জন্য মটকা, ড্রাম, টিন পলিথিন ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। পোকামাকড় দমনের জন্য পাত্রের তলদেশ ও উপরিভাগ শুকনো নিম পাতা বা বিষকাটালীর পাতা গুঁড়া করে দিতে হবে।
বংশ বিস্তারঃ বাংলাদেশে বর্তমানে বীজের মাধ্যমে সয়াবিনের বংশ বিস্তার/চাষাবাদ করা হচ্ছে। এক মৌসুমের বীজ দ্বারা পরবর্তী মৌসুমে সয়াবিন আবাদ করা যায়।
বিকল্প ব্যবহারঃ সয়াময়দা, সয়াডাল, সয়াবিন ঘুগনি, সয়াবিন চটপটি, সয়া হালুয়া, সয়ামিষ্টি কুমড়ার তরকারী, সয়া আলুর তরকারী, সয়াশাক, সয়া ভাপা পিঠা, সয়াদুধ, সয়া ছানা বা তফু, কাঁচা সয়াবিন সয়া পোলাও এবং কাঁচা সয়াবিন লাউ তরকারী ইত্যাদি।
বাজারজাতকরণ এলাকাঃ বর্তমানে সয়াবিন যে সকল এলাকায় বেশি আবাদ হচ্ছে সেখানে ক্রেতাগণ চাষীগণের সাথে যোগাযোগ করে সয়াবিন ক্রয় করে নিচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালী, লক্ষ্ণীপুর, চাঁদপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন বাজারে মৌসুমে সয়াবিন ক্রয়/বিক্রয় হয়ে থাকে।
অধিক ফলনের জন্য পরামর্শঃ বাংলাদেশের সয়াবিনের গড় ফলন ৬০০ থেকে ৭০০ কেজি/একর। অথচ একটু চেষ্টা করলে তা ১০০০ থেকে ১২০০ কেজি/একর করা সম্ভব। ভালো ফলনের জন্য কৃষককে অবশ্যই পরিশ্রমী ও আন্তরিক হতে হবে। চাষের আগে স্থানীয় কৃষি অফিসে গিয়ে পরামর্শ নিতে হবে। ভালো বীজ ও সার যথা সময়ে সংগ্রহ করে সময়মতো জমিতে বপন করতে হবে। সম্ভব হলে জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। সময় মতো আগাছা দমন, সেচ প্রয়োগ, উপরি সার প্রয়োগ এবং পোকামাকড় দমন করতে হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!