হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস অর্থাৎ মাটি ছাড়া ঘাস চাষ
হাইড্রোপনিক পদ্ধতি হলো এমন এক আধুনিক পদ্ধতি যার মাধ্যমে নিয়মিত পানির সঙ্গে খনিজ মিশ্রণ স্প্রের মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য উৎপাদন করা যায়। এই পদ্ধতিতে মাটির কোনোরূপ সংস্পর্শ ছাড়াই ঘাস উৎপাদন সম্ভব।
মাটির স্পর্শ ছাড়াই পানির ওপর ফসল উৎপাদনের হাইড্রোপনিক পদ্ধতিটি আমাদের দেশে আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট।
সফল খামারের জন্য হাইড্রোপনিক পদ্ধতিঃ লাভজনক গবাদিপশুর খামার করতে গেলে সবার আগে খামারীর নিজস্ব ঘাসের ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
নেপিয়ার, জার্মান, ইপিল ইপিল, পারা, জাম্বো, গিনি, ভুট্টা বা আলফালফা চাষ করা যেতে পারে। এই ঘাসগুলা বহু বর্ষজীবী অর্থাৎ একবার লাগালে কয়েক বছর পর্যন্ত কেটে খাওয়ানো যায়। আর এক বছরের মধ্যে কয়েক বার কাটা যায়।
কিন্তু ঘাস চাষ করার মতো জমি যদি না থাকে, এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে যেকোনো ঘাসের উৎপাদন কমে যায়। তখন ঘাসের সংকট দেখা দিতে পারে।
এই সমস্যার একটি সহজ সমাধান হলো হাউড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস চাষ। বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে সারা বিশ্বেও এখন এটি জনপ্রিয় হচ্ছে। ডেইরি, গরু মোটাতাজাকরণ, ছাগল, ভেড়া, গড়াল, টার্কি, মুরগি, খরগোশ পালনে অত্যন্ত পুষ্টিমান সম্পন্ন গ্রিন ফডার হিসেবে এই পদ্ধতিতে চাষ করা ঘাস সরবরাহ করা যেতে পারে।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে খুব সহজে, অল্প জায়গায়, অল্প খরচে এবং কম সময়ের মধ্যে মান সম্মত পশুখাদ্য পেতে পারি। এর পুষ্টিগুণ সাধারণ উচ্চফলনশীল (উফশী) ঘাসের চেয়ে বেশি। তাছাড়া কীটনাশক, কৃমি এবং অন্যান্য পরজীবীমুক্ত অবস্থায় এই ঘাস উৎপাদিত হয় বলে এতে পুষ্টিমানও থাকে বেশি।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে গম, ছোলা, খেসারি, বার্লি, ভুট্টা, মাষকলাই বা গিয়েনা বীজ থেকে এই ঘাস উৎপন্ন করা যায়। এটি প্রোটিন, খনিজ লবণ, এনজাইম, ভিটামিন এ এবং ই-সমৃদ্ধ। এক কেজি বীজ থেকে মাত্র সাত অথবা আট দিনে সাত কেজি তাজা ঘাস উৎপাদন সম্ভব।
উপকরণ:
১. ২ কেজি পরিমাণ গম বা ভুট্টা (চারা গজাবে এমন)
২. কিছু পানি
৩. প্লাস্টিকের ট্রে বা ট্রের মতো পাত্র (৩’×২’×৩”) ( ছিদ্রযুক্ত )
৪. ঠান্ডা ও ছায়া যুক্ত পরিবেশ
৫. একটি নিংড়ানো পুরান তোয়ালে বা চটের বস্তা
৬. বালতি বা গামলা
ঘাস চাষ পদ্ধতিঃ প্রথমে ভুট্টা বা গমের বীজকে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর পানি ঝরিয়ে ভেজা চটের বস্তা অথবা কালো সুতি কাপড়ের ভেতরে করে ২৪ ঘণ্টা অন্ধকার স্থানে রাখতে হয়। শেষে এক পাশ ছিদ্রযুক্ত ট্রের ভেতরে পাতলা করে ওই বীজ বিছিয়ে কালো কাপড় দিয়ে দুই দিন ঢেকে রাখতে হবে।
এই দুই দিন খেয়াল রাখতে হয়, বাইরের আলো-বাতাস যেন না লাগে এবং ট্রেতে পানি জমে না থাকে। কাপড়টি সারাক্ষণ ভেজা রাখতে হয়। তৃতীয় দিন কাপড় সরিয়ে আধ ঘণ্টা পরপর পানি ছিটাতে হবে।
তারপর টিনশেডের একটি ঘরে বাঁশ বা কাঠের তাক বানিয়ে শেলফের মতো করে ট্রেগুলো সাজিয়ে রাখতে হবে। চাইলে লোহা বা কাঠ দিয়ে আরো ভালো একটা সিস্টেম বানিয়ে নেওয়া যাবে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি স্প্রে করার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
সঠিকভাবে পানি স্প্রে করলে সাত থেকে নয় দিনের মধ্যে চারাগুলো ৬-৯ ইঞ্চি হবে। তখন খাওয়ানোর উপযুক্ত হবে।
এক কেজি পরিমান ভুট্টা বা গমের বীজ থাকে ৯ দিনে প্রায় ৭-৮ কেজি পরিমাণ গ্রিন ফোডার পাওয়া যাবে।
যদি তাক বানিয়ে ট্রে সাজানো হয় তাহলে অবশ্যই প্রত্যেকটি তাকে ট্রে সাজানোর মাঝখানে হিসাব করে দিনের ব্যবধান রাখতে হবে যেন ঘাস পাওয়ার জন্য আরও সাত দিন অপেক্ষায় থাকতে না হয়।
একটি তাক শেষ হতেই আরেকটি খাওয়ানোর উপযুক্ত হবে। যেমন : সাতটি তাক হলে এক দিনের ব্যবধানে ট্রে সাজাতে হবে। তাহলে সাত দিন পর দৈনিক একটি তাক থেকে ঘাস সংগ্রহ করা যাবে।
হাইড্রোপনিক গ্রিন ফোডারের উপকারিতা:
- এটি গাভির আঁশ জাতীয় খাদ্যের পাশাপাশি উদ্ভিজ আমিষ ও নানাবিধ প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ লবণের উৎস হিসেবে কাজ করে। এতে প্রোটিনের (আমিষ) পরিমাণ ৩১.৯৯% কিন্তু সাধারণ ঘাসে প্রোটিন থাকে ১১.৫%।
- এনার্জি (শক্তি) : ৪৭২৭ কিলোক্যালরি/কেজি আর সাধারণ ঘাসে ২৬০০ কিলো ক্যালরি/কেজি। তাই সাধারণ ঘাস দিনে তিন বার লাগে আর এটা দুই বার দিলেই হয়।
- ২৪০ কেজি পরিমাণ ঘাস ফলাতে জমি লাগে ২১৭৮ বর্গফুট আর সমপরিমাণ গ্রিন ফোডার ফলাতে ২২৯ বর্গফুট জায়গা (ছায়াযুক্ত স্থান বা ঘরেও করা যেতে পারে)।
- সাধারণত ৮০ লিটার পানি খরচ করে যে পরিমাণ ঘাস পাওয়া যায়। সে পরিমান গ্রিন ফোডার ফলাতে মাত্র ৩ লিটার পানি লাগে।
- ৭-৯ দিনে এই ফোডার যে পরিমাণ বাড়ে, সে পরিমাণ সাধারণ ঘাস বড় হতে লাগে ৩৭-৪০ দিন।
- গ্রিন ফোডার নিরাপদ, ফুড পয়জনিংয়ের সম্ভাবনা নাই, দূষণ মুক্ত। ( তবে সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত নয়)।
- এটা সহজেই গবাদিপশুকে পরিবেশন করা যায়। কাটা কাটির দরকার হয় না।
- এটা গবাদিপশুর স্বাস্থ্য ভালো করে এবং দ্রুত প্রজননক্ষম করে। কারণ এতে অনেক ভিটামিন উপাদান আছে।
- ১ কেজি ফডারের উৎপাদন খরচ ২.৫-৪ টাকা মাত্র। এর মাধ্যমে খামারের শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়।
- এই পদ্ধতিতে সারা বছর ঘাস উৎপাদন করা সম্ভব।
- এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, হাইড্রোফনিক ফডার গাভিকে খাওয়ালে ৩ লিটার পর্যন্ত দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে পাশাপাশি দুধের ফ্যাট ও এসএনএফ (সলিড নট ফ্যাট) পর্যাক্রমে ০.৩%-০.৫% বৃদ্ধি পায়।
সতর্কতাঃ হাইড্রোপনিক ঘাসে আমিষের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে কিন্তু ফাইবারের (আঁশ) কম থাকে। এ কারণে ননরুমিনেন্ট (অরোমন্থক প্রাণী) প্রাণী যেমন : খরগোশ, গিনিপিগ, টার্কি, মুরগীর জন্য স্বাস্থ্যকর হলেও রুমিনেন্ট পশু যেমনঃ গরু, ছাগলের জন্য হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া ছত্রাকের মোল্ড (White Mold) সমস্যাও হতে পারে।
সম্ভাবনাঃ হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সারা বছরই ঘাসের পাশাপাশি সবজি ও ফসল উৎপাদনও করা সম্ভব। প্রতি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিবিধ কারণে ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ। তাই মাটি ছাড়াই পশুখাদ্যের চাহিদা পূরণে হাইড্রোফনিক চাষ পদ্ধতি হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট কৌশল।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!