জামরুলের চাষ পদ্ধতি। ছাদে জামরুলের চাষ এবং জাতসমূহের বর্ণনা
জামরুল রসালো ও হালকা মিষ্টি স্বাদযুক্ত একটি ফল। গ্রীষ্মকালে এর চাহিদা অনেক। এটি ভিটামিন বি-২ সমৃদ্ধ ফল। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাপক হারে এই ফলের চাষ করা হচ্ছে।
জামরুলের জাতঃ বারি জামরুল-১, বারি জামরুল-২, বারি জামরুল-৩, থাই জামরুল, রোজ আপেল, বাউজামরুল-১, বাউজামরুল-২, বাউজামরুল-৩ ইত্যাদি। জামরুল লাল, সাদা, গোলাপি, গোলাপি সবুজ প্রভৃতি রঙের হয়ে থাকে।
বারি জামরুল ১ (আপেল জামরুল): বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত এ জাতটি প্রতি বছর ফলধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। এ জাতের পাকা ফল দেখতে আকর্ষণীয় মেরুন বর্ণের এবং খেতে সুস্বাদু। এ জাতের জামরুল আঁশবিহীন, খেতে সুস্বাদু ও মধ্যম রসালো। ফলের রঙ মেরুণ বলে অনেকে একে আপেল জামরুল নামেও ডাকেন। ফেব্রুয়ারি-মার্চ (মধ্য মাঘ থেকে মধ্য চৈত্র ) মাসে ফুল আসে এবং এপ্রিল-মে (মধ্য চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ ) মাসে ফল পাকে। ফল বড়, প্রতিটি ফলের ওজন ৩৫-৪৫ গ্রাম। গাছপ্রতি ১১০০-১৪০০টি ফল ধরে থাকে। এই জাতের হেক্টরপ্রতি ফলন ২০ টন। এ জাতটি ছাদে ড্রামে লাগানোর জন্য বাছাই করতে পারেন।
বারি জামরুল-২: কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম জামরুলের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে যা বছরে তিনবার ফল প্রদান করে থাকে যা ‘বারি জামরুল-২’ নামে জাতীয় বীজবোর্ড কর্তৃক নিবন্ধন প্রাপ্ত হয়েছে। ‘বারি জামরুল-২’ নিয়মিত প্রচুর ফল উৎপাদনকারী উন্নত জাত। গাছ মাঝারী, অত্যধিক ঝোপালো এবং বছরে ৩ বার ফল দেয়। মধ্য-ফাল্গুন, মধ্য-বৈশাখ এবং আষাঢ় মাসের প্রথম ভাগে ‘বারি জামরুল-২’ হতে ফল আহরণ করা যাবে। পাকা ফল আকর্ষণীয় মেরুন বর্ণের এবং খেতে সুস্বাদ, রসালো ও মিষ্টি। ফলের গড় ওজন ৪০ গ্রাম। এই জাতটি গাছপ্রতি ২০০০-২৫০০টি ফল দিয়ে থাকে। হেক্টরপ্রতি ফলন ২০-২৫ টন। জাতটি দেশের সর্বত্র চাষের উপযোগী।
বারি জামরুল-৩: এটি নিয়মিত ফলদানকারী, উচ্চফলনশীল জাত। পরিপক্ক ফলের রং আকষণীয় লালচে খয়েরী। ফল ঘণ্টাকৃতি, ফলের শাঁস আটশাটে, সাদা, কচকচে, খেতে খুবই মিষ্টি। এপ্রিল – মে মাসে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৫৯ গ্রাম এবং ফলন ৬.৬ টন/হেক্টর।
থাই জামরুল: বাংলাদেশে এখন কয়েক জাতের থাই জামরুল দেখা যাচ্ছে। এক জাতের থাই জামরুলের রং মোমের মতো সাদা, কিন্ত মুখের কাছে গোলাপি আভা। অন্য এক জাতের থাই জামরুলের রঙ সবুজাভ সাদা, অন্যটির রঙ দুধের মতো সাদা। আবার আরেক জাত আছে যেটার ফলের ওপর সাদা লম্বালম্বিভাবে গোলাপি আঁচড় আছে। লাল রঙের থাই জামরুলের আকার তুলনামূলকভাবে ছোট। তবে সব জাতের সেরা বড় আকারে সাদা রঙের মিষ্টি থাই জামরুল। দশটিতেই এক কেজি হয়ে থাকে। স্বাদে বেশ রসালো ও নরম। গ্রীষ্মের প্রথম থেকে ফল ধরতে শুরু করে বর্ষাতেও ফল ধরে। বছরে দু-তিন বার ফল ধরে থাকে। তবে বর্ষার জামরুলের স্বাদ কম হয়। ফল গাছে বেশি পাকলে স্বাদ কমে যায়, চেহারা নষ্ট হয়ে যায় ও পচতে শুরু করে। বেশি বৃষ্টিতেও থাই জামরুলের ক্ষতি হয়।
রোজ অ্যাপেল: থাই জামরুলের মধ্যে ‘রোজ আপেল’ সেরা। বছরে দু’বার ফল ধরে। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে একবার, এপ্রিল-মে মাসে আরেকবার। ফল আকারে খুব বড়। পাঁচ-ছ’টা জামরুলে এক কেজি হয়। ভেতরে পুরোটাই শাঁস। অত্যধিক মিষ্টি, শাঁসে চিনি বা সুগারের পরিমাণ প্রায় ২৫%। রং টকটকে লাল হয়ে থাকে। অন্য জামরুল যেমন পাকার পর পরই গাছ থেকে ঝরে পড়ে, এটা তেমন নয়।
জামরুলের উপকারিতাঃ জামরুলে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি ছাড়াও আয়রন, ক্যালসিয়াম, সালফার,পটাশিয়াম ইত্যাদি উপাদান বিদ্যমান। ডায়াবেটিক রোগীর জন্য জামরুল খুবই উপকারী। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে এবং ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় জামরুল খুব ভালো কাজ করে থাকে। বাত নিরাময় এবং চোখের নিচের কালো দাগ দূর করতেও জামরুল গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
জামরুলের উৎপাদন প্রযুক্তিঃ
চারা তৈরি: সাধারণত শাখা কলম ও গুটি কলমের মাধ্যমে জামরুলের বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে।
চারা রোপণ: মে মাস থেকে জুলাই মাস জামরুল চাষের উপযুক্ত সময়। এই সময়ে গাছ লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। মধ্য-জ্যৈষ্ঠ থেকে মধ্য-আষাঢ় (জুন) মাসে ১ x ১ x ১ মিটার গর্ত করে তা ৩ সপ্তাহ উন্মুক্ত রাখতে হবে। এরপর ১০-১৫ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি এবং ২৫০ গ্রাম এমওপির মিশ্রণ প্রতি গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। গর্তে সার প্রয়োগের ৭-১০ দিন পরে চারা লাগাতে হবে। চারা ৫-৬ মিটার দূরে লাগাতে হবে।
সারের পরিমাণ: প্রতিটি গাছে বয়স অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। সারের পরিমাণ নিম্নরূপ-
গাছের বয়স | জৈব সার (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) |
১-৩ | ১৫-২০ | ২০০-২৫০ | ২০০-২৫০ | ২০০-২৫০ |
৪-৭ | ৪৫-৬০ | ৬০০-৭৫০ | ৬০০-৭৫০ | ৬০০-৭৫০ |
৭-১০ | ৭০-৮০ | ৮০০-১০০০ | ৮০০-১০০০ | ৮০০-১০০০ |
সার প্রয়োগ: সবটুকু সার দুই ভাগ করে মধ্য-বৈশাখ থেকে মধ্য-আষাঢ় (মে-জুন) ও মধ্য-ভাদ্র থেকে মধ্য-কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ২ বার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের চতুর্দিকে বৃত্তাকার নালা করে নালায় সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের পর নালা মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে।
পরিচর্যা: বছরে ২ বার গাছের গোড়ার মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে দিতে হবে। কলমের গাছের নিচের দিকের কিছু শাখা-প্রশাখা কেটে দিতে হবে। খরা মৌসুমে গাছে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে।
ছাদে জামরুলের চাষ: বাড়ির চারপাশে কোনো খোলা জায়গা না থাকলে ছাদে হাফ ড্রামেও জামরুল চাষ করা যায়। প্রথমে হাফ ড্রামের তলদেশে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ১ ইঞ্চি ব্যাসের ৪/৫টি ছিদ্র করে ছিদ্রগুলোর ওপর মাটির ভাঙ্গা টবের টুকরো বসিয়ে দিতে হবে। মে মাসের মধ্যেই অর্ধেক দোআঁশ মাটি ও অর্ধেক পচা গোবর বা জৈব সার মিশিয়ে হাফ ড্রামের দুই তৃতীয়াংশ ভরাট করতে হবে। আকার ভেদে প্রতিটি হাফ ড্রামে আনুমানিক ৫০-১০০ গ্রাম মিশ্রসার প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে ড্রামের ওপরের অন্তত দু’ ইঞ্চি খালি রেখে সার মাটি দিয়ে ড্রাম ভরাট করতে হবে। সার মাটি ভরাটের ১৫দিন পর হাফ ড্রামের মাঝখানে চারাগাছের মাটির বল পরিমাণ মাপের গর্ত করে গর্তের মাঝখানে চারা/ কলমটি লাগাতে হবে। চারা লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হবে। ছোট ও ফলন্ত গাছে প্রতি বছর বর্ষার আগে রাসায়নিক সার দিলে উপকার পাওয়া যাায়। ফলবান প্রতিটি গাছে বছরে ১ কেজি গোবর ৫০০ গ্রাম সরিষার খৈল ১ কেজি ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০০ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে চারদিকের মাটির সাথে নিড়ানি দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। এসব ঝামেলা মনে হলে ছাদবাগানের ড্রামে গাছ প্রতি ৪-৮টি ট্যাবলেট সার ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্যান্য পরিচর্যা মাটিতে লাগানো গাছের মতোই করতে হবে।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!